দেশে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে আক্রান্তের পাশাপাশি গত পাঁচ দিন ধরে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড ভেঙে গত ২৪ ঘণ্টায় এক দিনে পাঁচজন মারা গেছেন। এ নিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৭ জন। অন্যদিকে গতকাল এক দিনে সর্বোচ্চ ৪১ জন রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬৪।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো কারও দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এক দিনে মৃত্যু ও আক্রান্তের এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে মোট ৩৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত (কভিড-১৯) প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এক মাসের মধ্যে রোগীর সংখ্যা দেড়শো ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনা করলে করোনার প্রকোপ বেশি এমন দেশগুলোর কাছাকাছি (মৃত্যুর হার) চলে গেছে বাংলাদেশ। প্রতিদিনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর পর দেশে তিন-চার দিন ধরে অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা।
এমন অবস্থায় করোনা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ। মধ্য এপ্রিলে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারেÑ বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কতা গত পাঁচ দিন ধরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে এপ্রিল মাস পুরো সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এ সময় রোগটি নিয়ন্ত্রণে জেলা পর্যায় পর্যন্ত করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং উপজেলা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। যেহেতু রোগটি কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই বিভিন্ন স্তরে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হবে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্লাস্টার এরিয়া (একই এলাকায় কম দূরত্বে একাধিক আক্রান্ত) যেন আর বাড়তে না পারে, সে জন্য ক্লাস্টার এরিয়া ও এর আশপাশে কমিউনিটিতে কার থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা জানতে পরীক্ষার পরিধি ও সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ মুহূর্তে রোগটি নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষাই একমাত্র উপায়।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে দেওয়া বক্তব্যে চলতি মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস বড় ধাক্কা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই ভাইরাসটির প্রসারিত হওয়ার বিষয়টি অঙ্কের মতো। এপ্রিলে আমাদের দেশে এর ধাক্কা ব্যাপকভাবে আসবে। এ রকমই আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের কিছু প্রতিবেদনও আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেই অবস্থায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গতকাল মঙ্গলবার নতুন করে সতর্ক করে দিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, নতুন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গতি ধীর করার সময় আসেনি। এখনই কঠোর পদক্ষেপ থেকে সরে আসা যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে গতকাল সরকার দেশে লকডাউনের মেয়াদ আরও তিন দিন বাড়িয়েছে। এর আগে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সব অফিস-আদালত বন্ধ রাখার যে ঘোষণা সরকার দিয়েছিল, তা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ঢাকায়, ৯ এলাকা লকডাউন : গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৪১ জনের মধ্যে ২০ জনই ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত ১৬৪ জনের মধ্যে ৮৪ জনই ঢাকার। গত শনিবার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৬ জন। সোমবার এক দিনে ১২ জন আক্রান্ত হলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮ জন। গতকাল সর্বোচ্চ ২০ জন আক্রান্ত হলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪ জনে। অর্থাৎ দেশে মোট আক্রান্তের ৫১ শতাংশই ঢাকার।
আইইডিসিআর গত ৫ এপ্রিলের পর থেকে তাদের ওয়েবসাইটে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আক্রান্তের পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। ফলে সেদিন অর্থাৎ ৫ এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীর ২৯টি এলাকায় রোগটি ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। সর্বোচ্চ সংক্রমণ হওয়ায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন বাড়ছে। গতকাল পর্যন্ত নয়টি এলাকার বিভিন্ন বাড়ি লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। এসব এলাকার কেউ এখন বাইরে বের হতে পারবেন না, কেউ ঢুকতেও পারবেন না।
সংক্রমণের শুরুর দিকে ঢাকায় মিরপুরের টোলারবাগে ও বাসাবোতে রোগী পাওয়ার পর ওই দুই এলাকা আগেই লকডাউন করা হয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৪১ জনের মধ্যে ২০ জনই ঢাকার বলে নিশ্চিত হওয়ার পর মঙ্গলবার পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, আদাবর, বছিলা, বাড্ডা ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বিভিন্ন ভবন লকডাউন করার ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। পুরান ঢাকায় খাজে দেওয়ান লেনে একটি মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি ও এক নারীর নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ায় ওই এলাকার ২০০ ভবন লকডাউন করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ হটস্পট : ঢাকার পর সর্বোচ্চসংখ্যক সংক্রমণের কারণে নারায়ণগঞ্জকে ‘হটস্পট’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে আইইডিসিআর। গতকালও মোট আক্রান্ত ৪১ জনের মধ্যে ১৫ জনই নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার। এর আগে গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১১ জন। পরে গত সোমবার আরও ১২ জন আক্রান্ত হন। ফলে এখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৮ জনে। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের ২৯ শতাংশই এই জেলার। পুরো নারায়ণগঞ্জকে হটস্পট হিসেবে আইডেন্টিফাই করে সেখানে কোয়ারেন্টাইন কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পাঁচ জেলায় প্রবেশ ও বের হওয়া বন্ধ : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গতকাল দেশের আরও চারটি জেলায় প্রবেশ ও বের হওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলোÑ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনা। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব জেলার কেউ বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাইরে থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। এর আগে গত রবিবার ঢাকা মহানগরীতে প্রবেশ ও বের হওয়া বন্ধের ঘোষণা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে দুপুর ২টার মধ্যে সাধারণ মুদি দোকান এবং সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সুপার শপ ও সব ধরনের কাঁচাবাজার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
গতকাল পুরুষ আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি : গতকাল অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় যে ৫ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ ও একজন নারী। এদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব দুজন, দুজনের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব ও একজন চল্লিশোর্ধ্ব। দুজন ঢাকার ও তিনজন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার।
এ সময় মোট আক্রান্তের ২৮ জন পুরুষ এবং ১৩ জন নারী। আক্রান্তদের মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সী শিশু একজন। এছাড়া ১১-২০ বছর বয়সের মধ্যে ৪ জন, ২১-৩০ বছর বয়সের ১০ জন, ৩১-৪০ বছরের ৫ জন, ৪১-৫০ বছরের ৯ জন, ৫১-৬০ বছরের ৭ জন এবং ৫ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
এক দিনে সর্বোচ্চ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা : করোনার সংক্রমণ বাড়ায় সরকার ঢাকাসহ সারা দেশে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়িয়েছে। গত এক মাসে গতকালই সর্বোচ্চ ৭৯২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা হয়েছে ৬৭৯টি। এর আগে গত সোমবার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল ৫৫০টি ও পরীক্ষা করা হয়েছিল ৪৬৮টি। গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় নয়টি প্রতিষ্ঠানে ও ঢাকার বাইরে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষা হয়েছে। এ ছাড়া খুলনা ও সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল থেকে করোনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
মহাপরিচালকের পরামর্শ : করোনা প্রতিরোধে দেশের মানুষকে সতর্ক থেকে স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, সবাইকে বলতে চাই আপনার সুরক্ষা আপনার হাতে। করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। একজনের থেকে আরেকজন কমপক্ষে তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। একান্ত প্রয়োজন না হলে বাড়ির বাইরে যাবেন না। সর্দি-কাশি হলে বা বাড়ির বাইরে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। যারা কোয়ারেন্টাইনে আছেন, তারা কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইনের শর্তগুলো মেনে চলুন। সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশি-হাঁচি-গলা ব্যথা-শ্বাসকষ্ট হলে বাড়িতেই চিকিৎসা নিন। অথবা আমাদের হটলাইন নম্বরগুলোতে ফোন করুন। কভিড-১৯ অথবা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় জরুরি অবস্থা না হলে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জরুরি অবস্থা হলে আমাদের হাসপাতালগুলো রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা দেওয়ার জন্য খোলা রয়েছে। সেখানে যাবেন। আউটডোরগুলো সীমিত সময়ের জন্য খোলা রয়েছে। সেখানেও যেতে পারেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন