করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে সমন্বয়হীনতা তার একটা প্রমাণ হলো করোনা নিয়ে আজকের তথ্য বিভ্রাট। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক সকালে এক অনুষ্ঠানে বললেন যে, গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৯ জন এবং মারা গেছে ৪ জন। এর কিছুক্ষণ পরই করোনা নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হলো, ২৪ ঘন্টায় নতুন শনাক্ত ৩৫ জন এবং মারা গেছে ৩ জন। এই তথ্য বিভ্রাটের ব্যাখ্যাও দিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বললেন যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন তথ্য দিয়েছিলেন তখন পর্যন্ত সংখ্যাটা সেরকমই ছিল। পরবর্তীতে সেটা বেড়েছে। পরবর্তীতে আমরা হালনাগাদ তথ্য দিয়েছি। এটা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।
আক্রান্তের সংখ্যাটা নাহয় কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বেড়েছে। সেটা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ৪ জন মৃত ব্যক্তি যখন ৩ জনে পরিণত হন, তখন বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এই বিভ্রান্তি হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে। এরকম সমন্বয়হীনতা অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে।
গত জানুয়ারি মাস থেকেই করোনা মোকাবেলার জন্য নানারকম কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এরকমই দাবি করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবসময় বলে আসছে যে তারা দিন-রাত একাকার করে কাজ করছে এবং করোনা মোকাবেলার জন্য যা যা করা দরকার কোনো কিছু করতে তারা কার্পণ্য করছেন না। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, যেই মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রধান মন্ত্রণালয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, সেই মন্ত্রণালয়েরই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তাদের সমন্বয়হীনতার কয়েকটি নজির এখানে উপস্থাপন করা হলো-
১. করোনা মোকাবেলার সবচেয়ে বড় কাজটি ছিল সারাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। এই সচেতনতা তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল, একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত যেন এই বার্তাটা পৌছে যায় যে, করোনা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। এটা থেকে বাঁচার উপায় হলো ঘরে থাকা, নিরাপদে থাকা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল একেবারে প্রন্তিক পর্যায় পর্যন্ত এদেশে স্বাস্থ্য অবকাঠামো রয়েছে। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে কমিউনিটি হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে মূলত সচেতনতাই তৈরি করা হয়। সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।
সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এই ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে যদি সচেতনতা তৈরি করা যেত তাহলে সেটা অনেক কার্যকর হতো। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ যাবৎকালের কোনো মিটিংয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে দেখা যায় নি। কমিউনিটি ক্লিনিককে বাদ দিয়ে সারাদেশে করোনা মোকাবেলায় সচেতনতা তৈরির কাজ কি সফল হতে পারে?- এই প্রশ্ন উঠেছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
অনেকেই মনে করেন, যদি কমিউনিটি ক্লিনিককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতো তাহলে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনাটা সহজ হতো।
২. করোনা ভাইরাস হলো একটা সংক্রামক ব্যাধি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আলাদা একটি বিভাগ রয়েছে, যেটাকে বলা হয় সিডিসি অর্থাৎ কমিউনিক্যাবল ডিজিজেস কন্ট্রোল। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের এই বিভাগটি প্রায় অকার্যকর। আমরা দেখছি যে, শুরু থেকেই করোনার বিষয়গুলো করা হচ্ছে আইইডিসিআর এর মাধ্যমে। আইইডিসিআর মূলত একটা গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান। যারা বিভিন্ন রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে। অথচ সংক্রামক ব্যাধি নিরাময়ের কাজ হলো সিডিসির। সেই সিডিসিকে প্রায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।
৩. করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সচেতনতার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিচ্ছে। টেলিভিশনে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো পদচারনা চোখে পড়েনি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো নয়ই। অথচ সংবাদপত্রগুলো প্রতিদিন আর্তনাদ করছে যে, তাদের পাঠকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে তারা ঠিকমতো পত্রিকা দিতে পারছে না। নানা শ্রেণির মানুষ এখন অনলাইনে ঝুঁকেছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু সংবাদপত্রে হতশ্রী কিছু বিজ্ঞাপণ দিয়েই তাদের প্রচারণার কাজ সারতে চেয়েছে। অথচ করোনা নিয়ে সবচেয়ে বড় অপপ্রচার এবং গুজবগুলো ছড়ানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব একটি এমআইএস ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন করোনা নিয়ে প্রচারণা চালালো না তা এক বিস্ময়।
৪. করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে বেসরকারি চিকিৎসকদের নিয়ে। তারা চেম্বার বন্ধ করে রাখছেন এবং কাজে অনীহা দেখাচ্ছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার তাদের অনুরোধ জানাচ্ছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন এমনকি হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন হলো বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন)। বিএমএ হলো চিকিৎসকদের মূল সংগঠন। এই বিএমএ-কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলার কাজে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। আর এসব সমন্বয়হীনতার কারণেই বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশানুরূপ দৃঢ়তা দেখাতে পারছে না বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন