মসজিদ কেবল উপাসনালয় নয়। একই সঙ্গে এটি সামাজিক মিলনমেলা এবং একটি Mass communication centre বা গণযোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবেও স্বীকৃত। এখানে একজন সম্মানিত ইমামকে যেমন নামাজে ইমামতি করতে হয়; তেমনি সময়ের প্রয়োজনে সমাজের ইমাম হিসেবেও আবির্ভূত হতে হয়।
ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে মসজিদ সামষ্টিক কল্যাণে নাগরিক পরামর্শশালা হিসেবে বহু আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। জাতীয় ক্রান্তিকালে গুরুত্বপূর্ণ রাজ ফরমান ও প্রয়োজনীয় গণসচেতনতা সৃষ্টি হতো মসজিদ থেকে।
একটা সময় শিশু শিক্ষার হাতেখড়ি হতো মসজিদের আঙিনা থেকেই। এর বাইরে জনসেবা ও সমাজকল্যাণে মসজিদের মুসল্লিরা সম্মিলিত উদ্যোগে কাজ করতেন। নামাজে মুসল্লিরা ধনী-দরিদ্রের তফাৎ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে যে মানবিক সাম্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করতেন, সমাজে সেই সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় একে অন্যের আপদে পাশে এসে দাঁড়াতেন।
কালক্রমে মসজিদ তার সেই বহুমাত্রিক আবেদন ও ঐতিহ্যগত জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে দৈনন্দিন উপাসনার বাইরে মসজিদকেন্দ্রিক কল্যাণ ও সেবা তৎপরতা এবং বৈচিত্র্যময় কর্মমুখরতা বিরলদৃষ্ট।
একটা সময় মক্তব শিক্ষা যখন বহুল প্রচলিত ছিল; ভোরবেলায় মসজিদের আঙিনা শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত হতো। নগর সভ্যতায় গ্রামীণ সেই মনোরমা স্নিগ্ধ সকাল এ প্রজন্মের অচেনা।
দৈনন্দিন ধর্মাচারের বাইরে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার ফলে মসজিদের মধ্যমণি ইমামগণ সমাজের মূল জীবন প্রবাহের বাইরে অবস্থান করেন। চলতি সমাজ সংকট উত্তরণে ইমামগণ তাই অতটা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হতে পারেন না।
অথচ একটা সমাজে একজন ইমাম হলেন সর্বজন গ্রহণযোগ্য, বরেণ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এই আস্থা ও বিশ্বাসের সুবাদে তার সামনে বিশাল সুযোগ ছিল, সমাজে নানা ইতিবাচক ভূমিকা রাখার।
দুর্যোগে, মহামারীতে, ক্ষুধায়, দারিদ্র্যে, অভাবে-অনটনে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি থেকে জনকল্যাণে অতি সহজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতেন একজন ইমাম।
কোভিড-১৯ সৃষ্ট করোনা মহামারী ইমামকে তার সেই ঐতিহাসিক ও প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখার পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে।
বৈশ্বিক এ মহামারীর আর্থ-সামাজিক ধাক্কা অনেক প্রলম্বিত ও বিস্তৃত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। আলহামদুলিল্লাহ! বাংলাদেশে এখনও খুব নাজুক পরিস্থিতি তৈরি না হলেও ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অচলাবস্থা ও প্রাণহানির প্রভাবে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহে সুদূরপ্রসারী একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে।
সরকারের রূপকল্প ২১, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এ দুর্যোগ আমাদের বেশ বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে এটা সুনিশ্চিত।
তাই এর মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও সম্পৃক্ততা হওয়ায় চাই ব্যাপক এবং অংশগ্রহণমূলক। জাতিসংঘের ভাষায় ‘Leaving no one behind’ বা কাউকে পেছনে রেখে নয়।
মসজিদ যেহেতু আমাদের সমাজের প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র; তাই করোনার প্রাদুর্ভাবের কর্মযজ্ঞে তার সম্পৃক্ততা জরুরি। একই কথা মন্দির, প্যাগোডাসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। যেটি বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং অভাব-অনটনের সমস্যায় আগে থেকেই জর্জরিত। সেখানে ইমামদের উদ্যোগে এই দুর্যোগকালীন মসজিদকেন্দ্রিক ত্রাণ তৎপরতা সময়ের অপরিহার্য দাবি।
ব্যয় পদ্ধতি অনুযায়ী, দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে হলে একজন ব্যক্তিকে দৈনিক ২১২২ ক্যালরি খাদ্য খেতে হয়। বর্তমান বাজারে একজন ব্যক্তিকে এই ক্যালরি কিনতে মাসে কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা আয় করতে হবে।
অন্যদিকে হতদরিদ্র বলতে যে ব্যক্তি দৈনিক ১৮০৫ ক্যালরি খাদ্য কেনার অর্থ সংস্থান করতে পারেন না তাকে বোঝানো হয়। বাজার দরে যিনি মাসে ১ হাজার ৬০০ টাকার কম আয় করেন, তিনি হতদরিদ্র।
এই দুই প্রকারের দরিদ্র্ মিলে বাংলাদেশে এখন সার্বিক দরিদ্রের হার ২০.৫ শতাংশ। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।
বিবিএসের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে আছে। এর অধিকাংশই নারী। প্রায় ৩ কোটি ৫২ লাখ নারী শ্রমশক্তির বাইরে। আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় অনেক সময় নারীর অভাব অজানায় থেকে যায়।
বলাইবাহুল্য এ সব দরিদ্র্, বেকারত্ব, শ্রমহীনতা করোনার প্রাদুর্ভাবকে আরও প্রকট ও দীর্ঘমেয়াদে সংকটাপন্ন করে তুলবে। একান্নবর্তী পারিবারিক কাঠামোয় অনেক ক্ষেত্রে একজনের উপর বাকি সদস্যরা নির্ভরশীল। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিও এ সময় যদি বেকার হয়ে পড়েন, হতে পারেন তিনি দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র দোকানী, প্রবাসী কিংবা কারিগর; তাহলে সে পরিবারকে হয়তো ঋণ করতে হবে অথবা গচ্ছিত সঞ্চয় ভাঙতে হবে নতুবা অনাহারে থাকতে হবে।
যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের তো নুন আনতেই পান্তা ফুরায়। সঞ্চয় থাকবে কোত্থেকে? নিশ্চিত আয়ের উৎস না থাকায় সহজে তারা ঋণও পান না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দরিদ্রদের জামানত ছাড়া ঋণ দেয় না। কিছু অর্থলগ্নিকারী সংস্থা আছে যারা এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে উচ্চ সুদে ঋণের ব্যবসা করে থাকে।
দেশে খাতভিত্তিক শ্রমশক্তির পূর্ণাঙ্গ ড্যাটাবেইজ নাই। প্রথম আলোর এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক রয়েছেন ৭০ লাখ। লকডাউন পরিস্থিতিতে যারা বর্তমানে বেকার বসে আছেন। গাড়ির চাকা না ঘুরলে, তাদের মুখে আহারও জোটে না।
দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ৫ জনে ১ জন মানুষ দরিদ্র। এতে ধরা যায় সমাজে প্রতি ৫০০ পরিবারের ১০০টি পরিবার এমনিতেই দরিদ্র।
লকডাউনের কারণে শ্রম আয়, প্রবাসী আয়, সর্বপরি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেমে যাওয়ায় সাময়িক দারিদ্র্য বা আপদকালীন দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে। উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা ও যোগানের ফারাক হবে।
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে এবং পণ্যদর নিয়ন্ত্রিত না থাকলে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতাও হ্রাস পাবে। তাই আশংকা থেকে যায়, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো একটা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি বহু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসন হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্য বিষয়গুলোও যথাসম্ভব মনিটরিং করছে। প্রয়োজনীয় স্থানে সেনাবাহিনীও মোতায়েন রয়েছে। সুতরাং, সরকার তার সর্বাত্মক সামর্থ্য নিয়ে কাজ করতে সচেষ্ট। তদুপরি সমস্যার সমাধানে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসা উচিত।
সরকারপ্রধান ইতিমধ্যে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,‘দুর্যোগের সময়ই মনুষ্যত্বের পরীক্ষা হয়। এখনই সময় পরস্পরকে সহায়তা করার; মানবতা প্রদর্শনের।’
তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী তাদের সদস্যদের একদিনের বেতন সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষও তাই করেছে। বিদ্যানন্দসহ বিভিন্ন সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অনেক প্রশংসনীয় কাজ করছে।
কাজেই সামাজিক এই দায়বদ্ধতা থেকে মসজিদের ইমামরাও যদি উদ্যোগী হন, তাহলে সমাজের সচ্ছল মানুষজনের সহায়তায় ছোট ছোট ‘সামাজিক তহবিল’ গঠন করা যেতে পারে।
এ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তহবিল দিয়ে একজন ইমাম তার মসজিদ এলাকার অন্তত ৫টি অভাবী পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারেন; যেন পরিবারগুলো মোটামুটি মাসদুয়েক তাদের খাদ্য সংকট কাটাতে পারে।
সংসদে ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর প্রদত্ত তথ্য মতে সারা দেশে মসজিদের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। এই গৃহবাসকালীন একজন ইমামের উদ্যোগে প্রত্যেক মসজিদকেন্দ্রিক যদি অন্তত পাঁচটা পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করা সম্ভব হয়, উপকারভোগী পরিবারের সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ১২ লাখ। এটা একটা অনুমান মাত্র।
এই উদ্যোগে যদি ধারণার ৩০ শতাংশও বাস্তবায়ন হয়, সেটিও মহামারীর সংকট মোকাবেলায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। করোনার দীর্ঘস্থায়ী আশু প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে তুলতে বিশাল সামাজিক দায়বদ্ধতায় শ্রদ্ধাভাজন ইমামগণও অগ্রণী ভূমিকায় শামিল হয়ে ঐতিহাসিক অবদান রাখতে পারেন।
লেখক: মুহাম্মদ জিয়াউল হক, শিক্ষক ও বিতার্কিক, সাবেক সভাপতি, ঢাকা আলিয়া ডিবেটিং ক্লাব
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন