রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ করেন তরুণ রুবেল মিয়া। দিন শেষে যে মুজুরি জুটে তাতে মা-বাবা, ছোট ভাই-বোন নিয়ে কোনমতে সংসার চলে। কিন্তু করোনার কারণে গত ১০ দিন ধরে বেকার রুবেল। ঘরে থাকা হাজার খানেক নগদ টাকা শেষ হয়েছে ৫ দিন আগেই। এখন পকেট একেবারে খালি। তাই কাজের আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন।
নগরীর আম্বরখানায় বুধবার দুপুরে দেখা হয় রুবেলের সঙ্গে। কথা বলার জন্য ডাক দিতেই ছুটে আসেন কাজের আশায়। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই উদভ্রান্ত এই তরুণ সিলেটী ভাষায় এক নাগাড়ে বলেন, কিতা কাজ খরা লাগবো খউক্কা, দাম ফুড়ানি লাগতো নায়, আফনার যত খুশি অত দিলাইন যেন’(কি কাজ করতে হবে বলেন, মজুরি ঠিক করা লাগবে না, আপনার যত খুশি তত টাকা দিলেই চলবে)।
টাকার অভাবে দিশেহারা এই তরুণকে একটু থামিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, আমরা ভালা নায়, কষ্টে আছি, আফনারা বেশি করি লেখউক্কা, আমরা কাজ খরতাম চাই। রুবেল জানান, তার মতো দিনমজুরের বেশিরভাগের ঘরেই এখন হাহাকার চলছে। চাল-ডাল কিছু সহায়তা পেলেও এটা দিয়ে সংসার চলছে না। নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারের জন্য চাই নগদ টাকা। সেই টাকার কোন সংস্থান না থাকায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে। উপরন্তু মাসও শেষ হয়েছে। এখন দিতে হবে বাসা ভাড়া। কিন্তু এই টাকা জোগাড়ের কোন পথ পাচ্ছেন না তারা।
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে নির্মাণ শ্রমিকদের কদর বেশি। সারা বছরই এখানে নতুন বাসা-বাড়ি, মার্কেট নির্মাণের কাজ চলে। ফলে সিলেটের গ্রামাঞ্চলসহ সারা দেশ থেকেই দিনমজুরেরা সিলেট নগরীতে আসেন। প্রতিদিন ভোরে নগরীর আম্বরখানা, বন্দরবাজার, সুবিদবাজার, শিবগঞ্জ, শাহজালাল উপশহরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে শত শত নারী-পুরুষ হাতুড়ি, শাবল, বালতি, কোদাল, টুকরি হাতে নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। নির্মাণ কাজের ঠিকাদার কিংবা নির্মাণাধীন অনেক বাসা-বাড়ির মালিক নিজেই এসব জায়গায় গিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রমিককে কাজে নেন। মোটামুটি সবারই ভাগ্যে কমবেশি কাজ জুটে। দিনশেষে যে মজুরি পান, তাতেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু গত প্রায় পক্ষকাল থেকে পাল্টে গেছে চিরচেনা এই জীবনচিত্র।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বাসা-বাড়ির নির্মাণ কাজ। এসব বাসা-বাড়ি নির্মাণের অধিকাংশ টাকাই আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী কয়েক লাখ সিলেটী এখন নিজেদের জীবন নিয়েই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকের মৃত্যুর সংবাদও দেশে আসছে। ফলে প্রবাসীদের স্বজনরাও দেশে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।
নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, দুই সপ্তাহ আগেও মাঝে-মধ্যে কিছু কাজ পাওয়া গেলেও গত এক সপ্তাহ ধরে কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ফলে অল্প-বিস্তর যে সঞ্চয় ছিল, তাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। দিনেদিনে শ্রমিকদের হাহাকার কেবল বাড়ছে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরীতে অন্তত ২৫-৩০ হাজার রিকশা শ্রমিক রয়েছেন। সারা দেশে থেকেই এই শ্রমিকরা সিলেটে এসে বিভিন্ন বস্তি-বাড়িতে থেকে রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। করোনা পরিস্থিতির কারণে এই হাজার হাজার রিকশা শ্রমিকও চরম বিপাকে পড়েছেন। তাদের আয়-রোজগার নেই। কিছু আয়ের আশায় এরপরও অনেকে রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন। কিন্তু যাত্রী না পেয়ে অনেক চালকই খালি রিকশা নিয়ে ঘুরছেন নগরীর এদিকে-সেদিকে। বুধবার দুপুরে নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় রিকশা নিয়ে বসে থাকা চালক আজির মিয়া জানান, সকাল থেকে বের হয়ে ১শ টাকাও ভাড়া তুলতে পারেননি। তিনি আহাজারি করে বলেন, আমরা গরিব মানুষ, এভাবে আর কতদিন বাঁচবো।
দিনমজুর, রিকশা শ্রমিক, হকারসহ নিম্ন আয়ের লোকজন কষ্টে আছেন উল্লেখ করে সিলেট সিটি করপোরেপশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, অসহায় লোকজনকে সহায়তা করার জন্য সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে খাদ্য ফান্ড গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এই ফান্ডে সরকারি চাল এসেছে। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে দান করছেন। চাল, ডাল, আলু, তেল, লবনসহ নিত্যপণ্য প্যাকেট করে বিতরণ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে নগরীতে ৬০-৬৫ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার রাত থেকে এই ত্রামসামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা যার যার ওয়ার্ডের অসহায় লোকজনের তালিকা তৈরি করছেন। সেই তালিকা অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন