জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর একে একে বেরিয়ে আসছে মো. রাশিদুল ইসলামের নানা অপকর্মের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এতদিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করা ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার নানা তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন। অতিরিক্ত সচিব রাশিদুল ইসলাম জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রথমে নিয়োগ পেয়েছিলেন সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) হিসেবে। এই পদে নিয়োগ পেয়েই একের পর এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটাতে শুরু করেন তিনি। ফাইল আটকিয়ে ঘুষ আদায় করতে প্লট হস্তান্তর, নাম জারির মতো অনেক সাধারণ কার্যক্রমকেও জটিল করে ফেলেন রাশিদুল ইসলাম। তার সময়ে সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) এর দফতরে শত শত ফাইল আটকা পড়ে যায়।
ঘুষ আদায় করতে সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহীতাদের এতোটাই হয়রানির মধ্যে ফেলা হতো যে, দেখা গেছে কোনো জমি ১৯৫৯/৬০ সালে অধিগ্রহণ হয়েছে। সেই সময়ের ক্ষতিপূরণের চেকের ফটোকপি চেয়ে বসেছেন রাশিদুল ইসলাম। এমনকি ফাইলে যেসব কাগজপত্র থাকতো সেগুলো আবার নতুন করে চাওয়া হতো শুধুমাত্র হয়রানি করতে। এমনসব এক গাদা কাগজপত্র চাওয়া হতো যেগুলো আদৌ কারো পক্ষেই জমা দেয়া সম্ভব নয়। রাশিদুল ইসলাম নিজেও জানেন, ১৯৫৯/৬০ সময়ের ক্ষতিপূরণের চেকের কপি কেউই জমা দিতে পারবেন না। কারণ, প্রতিটি চেক ইস্যু হয়-ই এক কপি। এর কোনো ডুপ্লিকেট কপি থাকে না। জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিগ্রস্থরা সেই চেক ব্যাংকে জমা দিয়েই ক্ষতিপূরণের টাকা তুলেছেন। তখন ফটোকপির যুগও ছিল না যে, সেটি কপি করে রাখা যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাশিদুল ইসলাম আজগুবি এসব জটিলতা তৈরি করতেন মূলত সাধারণ সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি ও ভোগান্তির মধ্যে ফেলে অর্থ আদায়ের জন্য। ওই সময়ে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) হিসেবে দায়িত্বে থাকা রাশিদুল ইসলাম কেবলমাত্র তার ড্রাইভার ও পিয়নের মাধ্যমে আসা ফাইলগুলো অনুমোদন করতেন। অন্য কারো ফাইল তিনি অনুমোদন করতেন না।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হওয়ার পর তার এসব অপকর্ম আরো বেড়ে যায়। রাশিদুল ইসলাম নিজেকে একজন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে দাবি করলেও বাস্তবে তার এ অপকর্মগুলো চলতো ওপেন-সিক্রেটই। কিন্তু সবাই জানলেও কেউ ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতো না। কারণ, তিনি পুরো প্রতিষ্ঠানটিতে ওই সময় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তার কথা না শুনলেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি-সাসপেন্ডসহ নানা হয়রানির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ফলে অন্যরাও আর ভয়ে মুখ খুলেনি। রাশিদুল ইসলাম চেয়ারম্যান হবার পরও আগের সেই গাড়িচালক খায়ের-এর মাধ্যমেই সব লেনদেনের কাজগুলো করতেন।
তবে এ অপকর্মগুলো জায়েজ করার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নানাভাবে খুশি রাখার নীতি অনুসরণ করতেন। দেখা গেছে, সময়মতো আবেদন করেননি এবং পরে আর আবেদনেরও সুযোগ নেই- এমন ব্যক্তিদের নামেও রাশিদুল ইসলাম ফ্ল্যাট-প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরের প্রকল্পে এ রকমের অনেককে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেন তিনি। প্রভাবশালী কয়েকজন সচিবও এই তালিকায় রয়েছেন। “ঢাকার ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরস্থ বিভিন্ন পরিত্যক্ত বাড়িতে আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (গৃহায়ন ধানমন্ডি) (১ম পর্যায়)” শীর্ষক প্রকল্পে এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে ন্যূনতম কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এমনকি এসব প্রকল্পের পিপি/ ডিপিপি হয়নি। প্রকল্প পাস হয়নি, নকসা-ডিজাইন কিছুই হয়নি, তার আগেই ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দপত্র ইস্যুও হয়েছে। তাও আবার যারা আবেদন করেননি সেই সব ব্যক্তিদের নামে।
মো. রাশিদুল ইসলাম জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে আসীন হন ২০১৮ সালের ৮ জুলাই। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতিবাজদের একত্র করে নতুন সিন্ডিকেট গড়ে তুলে প্রতিষ্ঠানটিকে হরিলুটের আখড়ায় পরিণত করেন। একইসঙ্গে আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি অর্থ ব্যয় করেন। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো ছিল তার নখদর্পণে। এ কারণে শীর্ষ পদে আসীন হবার পর তার মধ্যে ‘ড্যামকেয়ার’ ভাব চলে আসে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দুর্নীতির থাবা বিস্তার শুরু করেন। নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়াসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। রাশিদুল ইসলামের এসব অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ভবনে সাংবাদিকদের প্রবেশই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি রাশিদুল ইসলামের নানা দুর্নীতি, জালিয়াতি, অপকর্ম নিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও তার বেপরোয়া কর্মকাণ্ড থামেনি। জাতীয় গোয়েন্দা নিরাপত্তা অধিদফতর- এনএসআই’র গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাশিদুল ইসলামের মানসিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিভিন্ন সচিবসহ রাঘব-বোয়ালদের ফ্ল্যাট-প্লটসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে চেয়ারম্যান পদকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়াতে পারেনি। যে বা যারাই তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তাদেরকে হুমকি-ধামকি, শাস্তিমূলক বদলি, বহিষ্কারসহ নানাভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছে। সবসময় সরকারের প্রভাবশালী মহল ও প্রশাসনের বড়কর্তাদের ম্যানেজ করে চলেছেন। তাই অনিয়ম, দুর্নীতিতে কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। রাশিদুলের এসব অপকর্মের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে প্রভাবশালী কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে এনএসআই প্রতিবেদনে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১৬ মার্চ ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন