বিশ্বব্যাপী নোভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সকল মানুষ আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এই আতঙ্কের পেছনে কারণ নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করা যায়। করোনা ভাইরাসের বিস্তারের মাত্রা এবং প্রাণঘাতী এই রোগে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, সেইসঙ্গে ভাইরাসটি যে গতিতে ছড়াচ্ছে তা এখনও গবেষণাহীন থাকায় এবং সুনির্দিষ্ট কোনও প্রতিকার কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় মৃত্যুঝুঁকিতে তামাম বিশ্ব। কখন কাকে সংক্রমিত করে, কখন কারা প্রাণ কেড়ে নেয়, কখন কার দ্বারা কে সংক্রমিত হয়- তা জানা নেই কারোরই।
কোন বস্তুতে করোনা ভাইরাস কতক্ষণ জীবিত থাকতে পারে এ নিয়ে গেল কিছুদিন ধরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এখনও হচ্ছে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে নভেল করোনা ভাইরাস একেবারে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে- এরকম একটা ভীতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে। ফলে একদিকে সারা দেশে যোগাযোগ বিছিন্নতা আরেকদিকে সংক্রমণ ভীতি সংবাদপত্রের বিক্রি নামিয়ে এনেছে হুহু করে। মাত্র কয়েকদিনেই ছাপানো পত্রিকার বিক্রি কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় হকারের মাধ্যমে আসা ছাপানো সংবাদপত্রও এড়িয়ে চলছেন অনেকে। সংক্রমণ এড়াতে নগদ টাকা, মোবাইল হ্যান্ডসেট, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের ব্যবহৃত হেলমেট, পত্রিকা ধরতে এখন সতর্কতা অবলম্বন করছে মানুষ।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোনও সংক্রমিত ব্যক্তি বাণিজ্যিক পণ্যগুলোকে দূষিত করার আশঙ্কা কম থাকে এবং যে মোড়ক সরানো হয়েছে, ভ্রমণ করেছে এবং বিভিন্ন অবস্থা ও তাপমাত্রায় উন্মোচিত হয়েছে তার থেকে কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও কম থাকে।
হাতে হাতে বিলি-বিক্রয় করা কাগজের পত্রিকার এমন অচলাবস্থায় অলনাইন গণমাধ্যমের ওপর আস্থা ও চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে পাঠকের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে দেশে দেশে লকডাউন চলছে। বাসাবাড়ি থেকে কেউ বের হচ্ছে না। তাই সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে হকারের হাত থেকে পত্রিকাও নিতে চাচ্ছে না অনেকে। এমতাবস্থায় বাসায় ছাপানো পত্রিকা নেয়া বন্ধ করে দিয়ে অনলাইনের ওপর নজর দিচ্ছে মানুষ।
গত ১৫ দিন ধরে রাজধানীসহ সারা দেশেই সংবাদপত্রের চাহিদা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। তার আগের তুলনায় গত মঙ্গলবার সংবাদপত্রের বিক্রি ৬০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে হকার্স ইউনিয়ন। গত কয়েকদিনে ঢাকার বাইরের কয়েকটি সংবাদপত্র ঘোষণা দিয়েই ছাপানো বন্ধ করেছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য প্রকাশিত ৯টি সাপ্তাহিক প্রিন্ট পত্রিকা ছাপানো স্থগিত হয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র মালিকদের একটি সংগঠন নোয়াবকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাঠক ধরে রাখার প্রয়াস চালাতে দেখা গেছে।
ঢাকাভিত্তিক সংবাদপত্র হকারদের সংগঠন সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির হিসাবরক্ষক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘অনেক বাসাবাড়িই লকডাউন করে দিয়েছে, কাউকেই তো ঢুকতেই দিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘অনেকেই হুট করেই ফোন দিয়ে বলছে পত্রিকা দিয়েন না। একজন বন্ধ করলেই আরেকজনের মাথায়ও এটা কাজ করে যে, আমরাও বন্ধ করে দিই। এরকম অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন। বলতে গেলে গত ১৫ দিনে ঢাকায় পত্রিকা বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গেছে।’
হার্টফোর্ড হেলথকেয়ার বলছে, আপনার ঘরে পৌঁছে দেয়া জিনিস নিয়ে ভয় পাবেন না। করোনা ভাইরাস কোনও জিনিসের ওপর দীর্ঘক্ষণ টিকে থাকতে পারে না।
গত সপ্তাহে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন–এ একটি গবেষণার ফল ছাপা হয়েছে। গবেষণাটি করেছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল, ইউসিএলএ এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন রকম পৃষ্ঠে করোনাভাইরাস কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে, গবেষণায় তা দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কার হার সবচেয়ে কম হচ্ছে তামা থেকে। সম্ভবত তামার আণবিক গঠন এর কারণ। আর কম ছড়ায় কার্ডবোর্ড থেকে। যার কারণ হতে পারে কার্ডবোর্ড ছিদ্রযুক্ত।
ছিদ্র নেই আর মসৃণ পৃষ্ঠে করোনা ভাইরাস টিকে থাকে সবচেয়ে বেশি সময়। গবেষকেরা দেখেছেন যে প্লাস্টিক আর স্টেইনলেস স্টিলে এ ভাইরাস টেকে তিন দিনের বেশি। তবে এটি শুনতে যত ভয়াবহ মনে হচ্ছে, ততটা হয়তো নয়। কারণ, বাতাসের সংস্পর্শে এলেই এটির শক্তি দ্রুত কমতে থাকে। বাতাসের স্পর্শে এলে প্রতি ৬৬ মিনিটে মধ্যে এর ক্ষমতা অর্ধেক হতে থাকে। তিন ঘণ্টা পর এর সংক্রমণের ক্ষমতা কমে হয় আট ভাগের এক ভাগ। ছয় ঘণ্টা পর তা হয়ে যায় মূল সংক্রমণ ক্ষমতার ২ শতাংশ।
নিউজপ্রিন্ট কাগজ কার্ডবোর্ডের চেয়ে অনেক বেশি ছিদ্রযুক্ত। আর তা মোটেও মসৃণ নয়। বরং অনেক কর্কশ। যেসব জিনিসে ভাইরাস টিকে থাকার আশঙ্কা সবচেয়ে কম, নিউজপ্রিন্ট তার মধ্যে অন্যতম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা.ডট নেট-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এমএকে জিলানী ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর থেকেই অনলাইনের ওপর মানুষের ঝোঁক আগের চেয়ে বেড়েছে। সবার হাতেই এখন মোবাইল, মোবাইলেই খবর পাওয়া যায়। অন্যদিকে প্রিন্ট ভার্সন পত্রিকারও এখন অনলাইন ভার্সন পাওয়া যায়। কোভিড-১৯ এর কারণে ছাপা পত্রিকায় প্রভাব পড়েছে। মূলত কাগজের মাধ্যমে কোভিড কখনো ছড়ায় না। কিন্তু যে হকারটা বাড়ি বাড়ি যায় কিংবা যে ট্র্যান্সপোর্টের মাধ্যমে যায় সেখানে ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে কিংবা ছড়াতে পারে। এরমধ্যে অনেক হকাররা বাড়ি চলে গেছে, অনেকেই করোনার ভয়ে বাইরে বের হচ্ছে কম। এজন্য প্রিন্ট পত্রিকা বাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও এক ধরনের বিলম্ব ও বিড়ম্বনা তৈরি হচ্ছে।’
প্রিন্ট পত্রিকার যারা আসল পাঠক তারা ওই পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ঠিকই ফলো করছে। কোভিড-১৯ এর পর থেকে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে রাতদিন পাঠকের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে।
জাগো নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘বৈষয়িক প্রেক্ষাপটে ছাপা পত্রিকা চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল এতদিন। শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই ছাপা পত্রিকার উপযোগিতা কমে যাচ্ছে। বিশ্ব এখন করোনায় আক্রান্ত। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। মানুষও উদ্বিগ্ন। সেই প্রেক্ষাপটে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো যেহেতু তাৎক্ষণিক নিউজটা দিতে পারছে সেজন্য পাঠাকেরাও অনলাইনের দিকেই ঝুঁকছে। দেশে যেসব অনলাইন গণমাধ্যম আছে এবং পত্রিকা ভার্সনের অনলাইন আছে সেখানে অনেক পাঠক লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই সংবাদপত্রের দুর্দিন যাচ্ছে, অন্যদিকে আরেকটি গুজব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কাগজের পত্রিকায় করোনা ভাইরাস ছড়ানোর। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এটা ভিত্তিহীন। এক্ষেত্রে আমাদেরও মন খারাপ হয়। করোনা ভাইরাস এসে সংবাদপত্র শিল্প একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এটা আমাদের কারো কাম্য নয়। মানুষ গুজবে কান দেবে না। সংবাদপত্র নিশ্চয়ই ভালো ভালো খবর দেয়। যারা একটু বয়োজ্যেষ্ঠ তারা ছাপা পত্রিকাতেই অভ্যস্ত। তারা এখনও সকাল বেলা এক কাপ চা হাতে পত্রিকার পাতা উল্টান।’
এদিকে কিছু মালিক যারা ইতোপূর্বে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন তারা চলমান করোনা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এবার পত্রিকা বন্ধ করে দেন কি-না এমন আশংকাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তবে সংকটময় এই মুহূর্তে সংবাদপত্র বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে সরকারকে এগিয়ে আসা জরুরি।
সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) হকারদের মধ্যে ৩,০০০ হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ২৩,০০০ মাস্ক ও ২৩,০০০ গ্লাভস বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংগঠনটি একটি বিবৃতিও দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘ছাপানো পত্রিকা করোনা ভাইরাস বহন করে না।’
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন