বরগুনার আমতলীতে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষ থেকে শানু হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি মরদেহ বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত শানু হাওলাদারের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ঘুষের টাকা না দেওয়ায় নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তিনি (শানু হাওলাদার) আত্মহত্যা করেছেন। এদিকে থানার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার রুমের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। থানার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুমে সন্দেহভাজন আসামি কীভাবে আত্মহত্যা করেন এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের কলাগাছিয়া গ্রামে ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর ইব্রাহিম নামে একজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যা মামলার এজাহারে নিহত শানু হাওলাদারের সৎভাই মিজানুর রহমান হাওলাদারকে আসামি করা হয়। ওই মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শানু হাওলদারকে গত সোমবার (২৩ মার্চ) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ধরে নিয়ে যায় আমতলী থানা পুলিশ।
শানুর ছেলে পরদিন (২৪ মার্চ) থানায় এসে শানু হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু বুধবার (২৫ মার্চ) পরিবারের লোকজন এসে শানুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে থানা থেকে খবর দেওয়া হয় শানু থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
নিহতের স্ত্রী ঝরনা বেগম বলেন, ‘সোমবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই পরিদর্শক (তদন্ত) আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যান। কী কারণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওসি আবুল বাশার স্যার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যেতে বলেছেন। এরপর মঙ্গলবার একবার আমার ছেলে দেখা করতে পারলেও পরদিন তার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'স্বামীকে ছাড়াতে হলে তিন লাখ টাকা দাবি করেন মনোরঞ্জন মিস্ত্রি। কিন্তু আমরা ১০ হাজার টাকা জোগাড় করে তাদের হাতে দিই। পুরো টাকা দিতে না পারায় আমার স্বামীকে ওরা নির্যাতন করে হত্যা করেছে।'
এ বিষয়ে আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার বলেন, 'তিনি একটি হত্যা মামলার আসামি, তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। একপর্যায়ে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে তদন্ত কর্মকর্তার রুমে গিয়ে আত্মহত্যা করেন।'
যে হত্যা মামলায় তাকে আসামি বলা হচ্ছে, সেই মামলার এজাহারে তার নাম নেই; তাহলে কী করে তিনি আসামি হলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, 'তদন্তে তিনি আসামি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।' এ সময় ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তদন্ত কর্মকর্তার রুমের পাশেই পুলিশের আরও একটি কক্ষ রয়েছে, যেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ অবস্থান করে। তাছাড়া তার অপর পাশে রয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুম। এর মধ্যে একজন মানুষ কীভাবে রশি নিয়ে এসে আত্মহত্যা করেছে এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর বরগুনা জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা কাদের বলেন, 'আমতলী থানা হাজতের মধ্যে একজনের মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে জনমনে বেশকিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, তাকে কেন গ্রেফতারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়নি? দ্বিতীয়ত, তার আত্মহত্যা করার যৌক্তিকতা কতটুকু? তৃতীয়ত, তিনি আত্মহত্যা করার উপকরণ কোথায় পেলেন এবং কীভাবে আত্মহত্যা করলেন? পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব বিষয় দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো ভিত্তিহীন মনে হচ্ছে। কেননা একজন আসামিকে গ্রেফতারের পর তার হাজতখানায় থাকার কথা, তিনি কী করে তদন্ত কর্মকর্তার রুমে গেলেন?'
সুজনের এই নেতা আরও বলেন, 'তিনি আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটি বিচারবিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বের করা হোক। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।'
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, 'থানার মধ্যে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে, তাহলে মানুষ কোথায় গিয়ে নিরাপত্তা পাবে? আবার পরিবারের দাবি ঘুষ না দেওয়ায় তাকে মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা ভীত সন্ত্রস্ত। যদি এমনটিই ঘটে যে, তাকে থানা হাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে, তবে তা হবে আইনের চরম বিপর্যয়।'
এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেন, 'থানার মধ্যে একজন আসামির আত্মহত্য অবশ্যই অযৌক্তিক। এ বিষয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি, তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন