২৫ মার্চ, ১৯৭১। দিনের ব্যস্ততা ছেড়ে মানুষ যখন গভীর ঘুমে তখনই গৃণ্য এক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। মধ্যরাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। প্রথম প্রহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে জাতি।
বাঙালি যখন অনিশ্চিত ভষ্যিতের দিকে, তখন ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সন্ধ্যা ৭টার দিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসে একটি সাহসী বজ্রকণ্ঠ, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’। পাঠ করেন স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র।
এতেই হতভম্ব, বিশৃঙ্খল জাতি যেন প্রাণ ফিরে পেল। জিয়ার ঘোষণাতেই দিশেহারা জাতি পায় অনুপ্রেরণা। মেজর জিয়ার কণ্ঠে সেই ঘোষণা মুহূর্তের মধ্যেই দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায়। জিয়ার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে দিশেহারা জাতি পঙ্গপালের ন্যায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা নয়, রাজধানী ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিদ্রোহ করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সংলগ্ন সেক্টরে সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন এবং দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের মুক্তিবাহিনীর প্রথম সামরিক ব্রিগেড জেড ফোর্স (Z Force) তথা জিয়াউর ফোর্স গঠিত হয়। এটির তুরা ব্রিগেড নামেও পরিচিতি আছে। ব্রিগেডটি বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এর অনুমোদন সাপেক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে গঠিত হয়। ৭ জুলাই, ১৯৭১ ব্রিগেডটি গঠিত হয় ১ম, ৩য় এবং ৮ম ব্যাটালিয়ন এর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সমন্বয়ে। এটাই ছিল তৎকালীন স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রথম একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড। পরে আক্রমণ ও প্রতিরোধ শত্রুদের বড় ধরনের চাপে ফেলতে সম্পূর্ণ দেশকে কিছু সেক্টর-এ ভাগ করা হয়।
মেজর জিয়া এবং তার বাহিনী সামনের সারি থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং বেশ কয়েকদিন তাঁরা চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগতভাবে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে প্রথমে তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, রাঙামাটি, মিরসরাই, রামগড়, ফেনী প্রভৃতি স্থানে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান, যুদ্ধ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল হতে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এবং তারপর জুন হতে অক্টোবর পর্যন্ত যুগপৎ ১১ নম্বর সেক্টরের ও জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য কৃতিত্বের ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি কুমিল্লার একটি বিগ্রেডের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে, ঐ বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রত্যক্ষ গণভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। শহীদ জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন নিবেদিত প্রাণ সৈনিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন