অধ্যাপক এম এম আকাশ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিকস রিসার্চ। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় দেশের উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে নির্মোহ প্রতিক্রিয়া জানান। বলেন, ‘উচ্চবিত্তের জাতীয় শিকড় বাংলাদেশে নেই। বিদেশে বাড়ি তাদের। তাদের সন্তানরা বাইরে পড়েন। দেশের খেটে খাওয়া মানুষই অর্থনীতির কাঠামো শক্ত রেখেছে।’ গণতন্ত্রহীন রাজনীতিতে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশ্লেষক। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : দেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন আগের পর্বে। রাজনীতির এমন নকশায় ভূ-রাজনীতিও বিশেষ গুরুত্ব পায়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ভূ-রাজনীতির কী মূল্যায়ন করবেন?
এম এম আকাশ : এই অঞ্চল নিয়ে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে। পুরো বিশ্ব এখন দু’ভাগে বিভক্ত। চীনকে সঙ্গে নিয়ে রাশিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি পক্ষ, যেখানে ভারতকে রাখতে চাইছে। মিয়ানমারও চীনের দিকে ঝুঁকে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার নীতি হচ্ছে, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র-কে নিয়ে একই সঙ্গে খেলা। খেলছেনও বটে। যেমন- সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীন, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে অর্থ দিতে চাইল। শেখ হাসিনা সবার কাছ থেকে অর্থ নিতে চাইলেন। তখন আর কেউ রাজি হলো না। কিন্তু পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থ বাতিল করায় ঠিকই চীনের কাছ থেকে সহায়তা নিল সরকার।
রোহিঙ্গা ইস্যুতেও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সমাধান চাইল সরকার। তার মানে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তথা চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত-কে নিয়ে শেখ হাসিনা একসঙ্গে খেলে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি মোটামুটি সফল।
জাগো নিউজ : এই সফলতা সাধারণ মানুষ কীভাবে মূল্যায়ন করছে?
এম এম আকাশ : পররাষ্ট্রনীতির এই সফলতায় শেখ হাসিনা টিকে থাকতে পারছেন। প্রশ্ন হচ্ছে আরেক জায়গায়। বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগত কারণেই ভারতবিরোধী।
পানি, বাণিজ্য, সীমান্ত হত্যা বা রামপালের ঘটনায় মানুষ ভারতের প্রতি ক্ষুব্ধ। এসব ইস্যু নিয়ে শেখ হাসিনা এমন কোনো অবস্থান তুলে ধরতে পারেননি, যা দেখে মানুষ খুশি থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ভারতের সঙ্গে দর কষাকষি করেছিলেন।
বিএনপি অবশ্য এই জন-আকাঙ্ক্ষা কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগকে ভারতপক্ষীয় রূপ দিতে চায়। আমরা সম্প্রতি তা-ই দেখেছি।
জাগো নিউজ : কিন্তু এটা তো বিএনপির জন্য ব্যর্থ চেষ্টা?
এম এম আকাশ : হুম। ভারত কখনও বিএনপিকে বিশ্বাস করবে না। তাদের জামায়াত ও পাকিস্তানপ্রীতির কারণেই ভারত বিএনপিকে বিশ্বাস করতে চাইবে না।
সাধারণ মানুষ ভারতবিরোধী থাকলেও শেখ হাসিনা চীনকে দিয়ে সেটা ব্যালেন্স করেছে। সুতরাং কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতেও আছে।
জাগো নিউজ : এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
এম এম আকাশ : আমাদের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারি ও বিরোধী দল উভয়কে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হতে হবে। জামায়াতের সঙ্গ থাকায় বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলা যায় না। হেফাজত ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি করে। বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলা যায়। কিন্তু তাদের বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে। তারা আর বিরোধী দল হতে পারছে না।
জাগো নিউজ : তাহলে বিকল্প কী?
এম এম আকাশ : আওয়ামী লীগ-বিএনপি জোটের বাইরে বামপন্থীদের একটি শক্তি আছে। তাদের যদি শেখ হাসিনা একটি স্পেস দিত (সুযোগ) এবং তারা যদি শক্তিশালী হতো, তাহলে গণতন্ত্র অর্থবহ হতো।
জাগো নিউজ : স্পেস কী আসলে দেয়ার ব্যাপার, না-কি করে নেয়ার ব্যাপার?
এম এম আকাশ : দুটোই। স্পেস করে দেয়ারও ব্যাপার, করে নেয়ারও ব্যাপার।
জাগো নিউজ : হেফাজতে ইসলামকেও স্পেস দিয়ে শেখ হাসিনা করুণা করেছেন বলে অনেকে বলেন। এমন করুণার স্পেস নিয়ে বামপন্থীরা আসলে কী ফল পাবে?
এম এম আকাশ : করুণার বিষয় নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উপযুক্ত বিরোধী দল না থাকলে সরকার ভালো থাকতে পারে না।
জাগো নিউজ : শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকির কথা বলছিলেন। এমন ঝুঁকি সামনে রেখে বামপন্থীদের সুযোগ দেবে কেন?
এম এম আকাশ : সেটা শেখ হাসিনার ভাবনার ব্যাপার। তবে আমার কাছে মনে হয়, তিনি একনায়কতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা জারি করে সিঙ্গাপুর, হংকং মডেলের কথা ভাবছেন।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের বাস্তবতা কী বলে?
এম এম আকাশ : শেখ হাসিনা তার ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন না, আমি অন্তত তা-ই মনে করি। বাংলাদেশে তা হবে না।
জাগো নিউজ : না হওয়ার কী কারণ?
এম এম আকাশ : দুই কারণে এটা হবে না। প্রথমত, সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারে। আরেকটি হতে পারে, সকল দল মিলে এমন একটি আন্দোলন, যেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলে আসবে।
এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাও দেখা দিতে পারে, যেটা ব্যাংক থেকে শুরু হবে।
জাগো নিউজ : ব্যাংক থেকে কেন?
এম এম আকাশ : ব্যাংক যেকোনো সময় বলতে পারে যে, আমরা গ্রাহককে আর টাকা দিতে পারছি না। একটা আতঙ্ক তৈরি হবে। এটা হলে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেবে। সরকারের বিনিয়োগ কমে যাবে। উন্নয়ন বরাদ্দ থেমে যাবে।
জাগো নিউজ : ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কী বলা যায়?
এম এম আকাশ : সরকার অতিমাত্রায় ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু ঋণ পাচ্ছে না, এমনটা হয়তো ঘটেনি। বিনিয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যদি ঋণ না দেয়া হয়, তাহলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কিন্তু সরকার যে ঋণ নিচ্ছে, তা তো ব্যয় করছেই। ফলে এখন পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু ব্যাংক নিয়ে নানা আলোচনাও আছে…
এম এম আকাশ : সেটা ভিন্ন আলোচনা। মূলত খেলাপিদের কাছে ব্যাংকের টাকা আটকে গেছে। প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। তবে ব্যাংকে যে টাকা আছে তা যদি কৃষক, উদ্যোক্তা, প্রবাসীদের জন্য কাজে লাগানো যায়, তাহলে অর্থনীতি আরও আলোকিত হবে।
কাজে লাগাতে পারবে কি-না সেটা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করে। কারণ ব্যাংকের মালিক তো একা সরকার নয়। সরকার চাইলেই সাধারণ মানুষ ব্যাংকিং সুবিধা পায় না।
জাগো নিউজ : বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। সার্বিক অর্থে উন্নয়ন নিয়ে কী বলা যায়?
এম এম আকাশ : প্রবৃদ্ধির অর্থে উন্নয়ন হচ্ছে। টাকা লেনদেন হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নামছে না। এগুলো উন্নয়নের ন্যূনতম সূচক কিন্তু যথেষ্ট নয়।
এই ধরনের উন্নয়ন টেকসই হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে সমতা, আত্মনির্ভরশীলতা, প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য, সুশাসনের ওপর। এগুলো খুবই দুর্বল। এ কারণেই অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এই উন্নয়ন টেকসই হবে না।
কিন্তু শেখ হাসিনা বলছেন, উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়াবে। কিন্তু এই বৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে, আত্মশুদ্ধি, সুশাসন, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, দুর্নীতি কমানো, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব পূর্বশর্ত নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম।
১৯৭২-১৯৭৫ সালে যে সংকট ছিল, এখনও ঠিক তা-ই। তখন বিশৃঙ্খলা সর্বত্রই। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দল ও প্রশাসন একে অপরকে দোষ দিয়ে গালিগালাজ করতে থাকল। শেখ মুজিব বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আর না। আমি নতুন দল গঠন করব। যেই কৃষক-শ্রমিক নিয়ে বাকশাল গঠন করে মানুষের ভাগ্য বদলাতে চাইলেন, তখনই তাকে হত্যা করা হলো। সিঙ্গেল ইঞ্জিনে সিঙ্গেল ম্যান। ম্যানকে মেরে ফেলার পর ইঞ্জিন টালমাটাল। এখনও তো সিঙ্গেল ইঞ্জিনে সিঙ্গেল ওম্যান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন