একদিকে পরিচালনা পর্ষদের একটি অংশের বিরোধিতা। অন্যদিকে কাজের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে বার্ষিক পদোন্নতি অথবা বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ। এমন পরিস্থিতিতে পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের আস্থা অর্জনই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ছানাউল হকের সামনে।
স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিচালনা পর্ষদের একটি অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও ডিএসই’র এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ছানাউল হক। আবার পর্ষদের যে সদস্যদের ভূমিকার কারণে ছানাউল হক এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের একজন বাদে সবাই পর্ষদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে বিরোধীদের সঙ্গে সঙ্গে পর্ষদের নতুন সদস্যদের আস্থা অর্জন করা এমডির জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এছাড়া ডিএসই’র কর্মকর্তাদের বার্ষিক কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রতিবছরই পদোন্নতি অথবা বেতন বাড়ানো হয়। কিন্তু নিয়মিত এমডি না থাকার অজুহাতে এবার কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ উচ্চ বেতনে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এবং এমটিও (ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার) পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন এমডি বার্ষিক কাজের মূল্যায়ন করে যোগ্যদের পদোন্নতি দেবেন বলে কর্মকর্তারা যে প্রত্যাশা করছেন, তার চাপও থাকছে ছানাউল হকের কাঁধে।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছর জোর করে জুনিয়রদের পুওর মার্কিং (কম নম্বর দেয়া) করে ডিপার্টমেন্টাল হেডদের আউটস্ট্যান্ডিং মার্কিং (বেশি নম্বর) দেয়া হয়। যেসব কর্মকর্তাদের পুওর মার্কিং দেয়া হয়, বছরশেষে তাদের পদোন্নতিও হয় না, বেতনও বাড়ে না। যারা আউটস্ট্যান্ডিং মার্কিং পান তাদের পদোন্নতিও হয়, বেতনও বাড়ে ৫ শতাংশ। আর যাদের গুড মার্কিং দেয়া হয় তাদের বেতন বাড়ে ৪ শতাংশ, তবে তারা পদোন্নতি পান না।
এবার কর্মকর্তাদের কাজের কোনো মূল্যায়নই করা হয়নি। এতে কর্মকর্তারা বঞ্চিত হলেও্ উচ্চ বেতনে এমটিও ও নির্বাহী পদে ১৩ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে এসব কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলেও কয়েক মাসের মধ্যে ৩ জন এমটিও এবং একজন নির্বাহী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ডিএসই’র এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, স্থায়ী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে বাইরে থেকে লোক নিয়োগ দেয়া হলেও তারা থাকছেন না। এতে একদিকে টাকার অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। ফলে ডিএসই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে আমরা আশা করছি নতুন এমডি সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে যোগ্য কর্মকর্তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন।
তিনি বলেন, মাসিক ২ লাখ টাকা বেতনে সিওও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার গাড়ি, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় নিলে মাসে বেতন-ভাতা দাঁড়ায় ৪ লাখ টাকার ওপরে। অথচ এই কর্মকর্তা মার্কেটের উন্নয়নে কোনো কাজ করছেন না। উল্টো ডিএসই থেকে কর্মকর্তা ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। এতে ডিএসই’র কর্তকর্তাদের মধ্য এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
ডিএসই’র উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডিএসইতে কাজ করছি। এবার এমডি নিয়োগ নিয়ে যা হয়েছে, ডিএসই’র কোনো কর্মকর্তা নিয়োগে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। ফলে নতুন এমডির জন্য স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা একটু সমস্যা হতে পারে। তবে পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তাদের আস্থা অর্জন করতে পারলে কোনো সমস্যা হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই’র পর্ষদের ১২ জন পরিচালকের মধ্যে সাতজনই স্বতন্ত্র পরিচালক। এদের মধ্যে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পাঁচজনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরা হলেন অধ্যাপক ড. আবুল হাশেম, সিদ্দিকুর রহমান মিয়া, মনোয়ারা হাকিম আলী, ওয়ালীউল ইসলাম ও ড. এম কায়কোবাদ। পরিচালকদের একটি অংশ ছানাউল হককে এমডি করার বিরোধিতা করলেও এই পাঁচজন তার পক্ষে ছিলেন। যে কারণে শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের বড় অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও এমডি পদে নিয়োগ পান ছানাউল হক।
ডিএসই’র এক সদস্য বলেন, পরিচালক রকিবুর রহমান ছাড়া ডিএসই’র বর্তমান কোনো শেয়ারহোল্ডারই ছানাউল হকের পক্ষে নেই। এমনকি কোনো কোনো শেয়ারহোল্ডার ইজিএম (অতিরিক্ত সাধারণ সভা) ডেকে এমডির বেতন কমানোর প্রস্তাবও দিয়েছেন। সুতরাং বর্তমান শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে যারা নিয়োগ পাবেন তাদের আস্থা অর্জন করতে না পারলে নতুন এমডির পক্ষে কাজ করা কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
dse
এ বিষয়ে কাজী ছানাউল হকের বক্তব্য নিতে কয়েক দফা তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি।
নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে কারা আসছেন
নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক বাছাই করতে বিএসইসিতে ১৮ জনের নামের প্রস্তাব পাঠিয়েছে ডিএসই। এর মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের প্রফেসর ড. খন্দকার বজলুল হক, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব নাসরিন বেগম, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সারিতা মিল্লাত, আইসিএবি’র ফেলো সদস্য সাব্বির আহম্মেদ, আইসিএবি’র ফেলো সদস্য মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন, বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম মাসুদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সালমা নাসরিন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুলতান মাহমুদ, এরো ভিশন বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরিক মোরশেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হাবিবুল্লাহ বাহার, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর মো. আমীর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর মো. মাসুদুর রহমান, পুলিশের সাবেক সুপারিন্টেডেন্ট মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আসিফ হোসাইন খান, এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মুনতাকিম আশরাফ, টেকনোহ্যাভেন ইনিস্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠাতা হাবিবুল্লাহ নিয়ামুল কবীর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান এবং টোকা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো .আব্দুল মোমেন। এদের মধ্য থেকে ৬ জনকে চূড়ান্ত করে দেবে বিএসইসি।
ডিএসই’র এমডি কাহিনি
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ডিএসই’র এমডি নিয়োগ-সংক্রান্ত ‘নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি (এনআরসি)’ কাজী ছানাউল হককে এমডি হিসেবে প্রাথমিকভাবে বেছে নেয়। এরপর ৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিএসই’র পর্ষদ সভায় তাকে এমডি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তবে পর্ষদ সভায় ডিএসই’র পরিচালনা পর্ষদের ৬ জন কাজী ছানাউল হককে এমডি হিসাবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সম্মতি জানান। বিপরীতে ৩ জন শেয়ারহোল্ডার পরিচালকসহ ৪ জন তার বিষয়ে আপত্তি জানান। আপত্তি জানানো শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, এমডি নিয়োগে স্বচ্ছ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি।
তারা অভিযোগ করেন, ডিএসই’র এমডি নিয়োগের বিষয়ে পর্ষদ সদস্যদের নোটিশ করতে হয়। কিন্তু এবার কোনো নোটিশ করা হয়নি। আবার এমডিকে পর্ষদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর রীতি থাকলেও তা করা হয়নি। এছাড়া আইসিবিতে (ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ) থাকা অবস্থায় কাজী ছানাউল হকের বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তাকে তলবও করা হয়। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখিও হয়েছে। এমন বিতর্কিত ব্যক্তিকে ডিএসই’র এমডি করা উচিত হবে না।
এমডি নিয়ে এমন বিতর্ক উঠলেও পর্ষদ সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ওইদিন ডিএসই থেকে কাজী ছানাউল হককে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য বিএসইসিতে আবেদন করা হয়। এরপর ১২ জানুয়ারি ডিএসই থেকে ছানাউল হকের বিষয়ে পর্ষদ সদস্যদের আপত্তিগুলো চিঠি দিয়ে বিএসইসিকে জানানো হয়। চিঠিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে এমডি নিয়োগের প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য বিএসইসিকে অনুরোধ করা হয়।
এরপর ২২ জানুয়ারি কমিশন সভা করে বিএসইসি কাজী ছানাউল হককে ডিএসই’র এমডি হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেয়।
বিএসইসি থেকে কাজী সানাউল হককে অনুমোদন দেয়ার পরদিনই ২৩ জানুয়ারি পর্ষদ সভায় বসে ডিএসই। ওই সভায় ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) নেতারাও অংশ নেন। এতে ডিএসই’র পর্ষদের একটি অংশের পাশাপাশি ডিবিএ নেতারাও কাজী ছানাউল হককে এমডি করার বিষয়ে আপত্তি তুলে ব্যাপক সমালোচনা করেন। এ পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে অনুমোদন পাওয়ার ১৬ দিনের মাথায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি ডিএসইতে যোগ দেন কাজী ছানাউল হক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন