নিহত দুই সন্তান ফারহান উদ্দিন (বাঁয়ে) ও লাইভা ভুঁইয়া (ডানে), মাঝে বাবা রাকিব উদ্দিন ভুঁইয়া।
রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রেমবাগান এলাকায় দুই সন্তানসহ মায়ের হত্যাকারী একজন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার আলামত ও ফরেনসিক এক্সপার্টদের মতামতের ভিত্তিতে এমন ধারণা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
গতকাল শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় প্রেমবাগানের একটি বাসার (হোল্ডিং নম্বর ৮৩৮) চতুর্থ তলা থেকে মা মুন্নী বেগম (৩৭) এবং দুই সন্তান ফারহান উদ্দিন (১২) ও লাইভা ভুঁইয়ার (৩) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পলাতক রয়েছে নিহত মুন্নীর স্বামী রাকিব উদ্দিন ভুঁইয়া। সে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডের (বিটিসিএল) উপসহকারী প্রকৌশলী।
প্রায় ১০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে ওই বাসায় ভাড়া থাকে রাকিব। সম্প্রতি বিটিসিএল-এর গুলশান কার্যালয় থেকে উত্তরা কার্যালয়ে বদলি হয় সে।
শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৪টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মরদেহ তিনটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় এখনও কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. এ কে এম মাইনুদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মরদেহ তিনটির উপরিভাগের বেশি অংশ পচে গিয়েছিল। নিহত নারীর মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন আছে। শিশু দুটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, এমন আলামত পাওয়া গেছে। মরদেহগুলো থেকে ভিসেরা ও রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।’
ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পেলে পুরো ঘটনা জানা যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মরদেহগুলোর আলামত দেখে পরিষ্কার বলা যায় যে, এই হত্যাকাণ্ড একজনই ঘটিয়েছে।’
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মায়ের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার কারণে তার মাথা থেঁতলে যায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি হাতুড়িও উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও ওই ফ্ল্যাট থেকে দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দক্ষিণখান এলাকায় গৃহকর্তা রাকিবকে শেষ দেখা গেছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তার অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিয়ে থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একাধিক টিম কাজ করছে। নিখোঁজ রাকিবকে পাওয়া গেলে এবং মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেলে এই হত্যাকাণ্ডের অনেক জট অনেকাংশেই খুলে যাবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরা দেখেছি, সেটি সচল রয়েছে। তবে এখনও ফুটেজ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফুটেজ উদ্ধারে আমরা এক্সপার্টদের সহযোগিতা নিচ্ছি।’
রাকিব এর আগেও নিখোঁজ ছিল—এমন কোনও তথ্যপ্রমাণ পুলিশ পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে নাবিদ কামাল বলেন, ‘স্থানীয় অনেকের কাছে শুনেছি, গত ৪/৫ মাস আগে রাকিব একবার নিখোঁজ হয়েছিল। কিছুদিন পর সে আবার ফিরে আসে। কিন্তু এবিষয় তাদের পক্ষ থেকে থানায় কোনও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়নি। এর কোনও ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি।’
রাকিবের কোনও মানসিক রোগ ছিল কিনা, এমন প্রশ্নে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে স্বজনদের কেউই কিছু বলেনি। তবে স্থানীয়দের কেউ কেউ বলছিল। সে কোথাও মানসিক চিকিৎসা নিয়েছে কিনা, সে বিষয়ে আমরা এখনও কোনও তথ্য-প্রমাণ পাইনি।’
দক্ষিণখানে প্রেমবাগান এলাকার ‘আশ্রয়’ নামের ওই বাড়ির মালিক মো. মনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে রাকিব উদ্দিন আমার বাসায় ভাড়া থাকে। এই দশ বছরে আমি তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও বিবাদ দেখিনি। হাঁটাচলার সময় তার সঙ্গে দেখা হতো। তার ব্যবহার খুব ভালো। এর আগে সে বাড্ডা এলাকায় ভাড়া ছিল, এরপর গুলশান এলাকায়।’
তিনি বলেন, ‘রাকিব কিছুটা ঋণগ্রস্ত ছিল বলে আমি শুনেছি। মুন্নী বেগমের ভাই সোহেল আহমেদ এ বিষয়ে থানায় স্টেটমেন্টও দিয়েছে। যতটুকু আমি জানি, গত বুধবার সোহেল ও রাকিবের মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিল।’
সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর আগে রাকিব নিখোঁজ হয়েছিল। এরপর গত ডিসেম্বরে আমি বাসার নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছি।’
শনিবার রাতে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিহত মুন্নি বেগম ও তার দুই সন্তানের লাশ দাফন করা হয়। মুন্নী বেগমের ভাই সোহেল আহমেদ এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এখনও বুঝতে পারছি না কারা এবং কেন তাদের হত্যা করলো। যেই হোক আমার বোন ও বোনের সন্তানদের হত্যাকারীর আমরা বিচার চাই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন