রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জেনারেল ম্যানেজার (মহাব্যবস্থাপক) পর্যায়ের পদে জনবল সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত ১৮ ডিসেম্বর ‘পুল’ এর মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে জেনারেল ম্যানেজার পদে পদোন্নতির জন্য সাক্ষাতকার নেয়া হয়। কিন্তু ৩৬টি শূন্য পদের বিপরীতে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ জন। এরফলে পদগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এখনই উত্তোরণের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হলে আগামীতে এ সংকট আরো চরম আকার ধারণ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। শুধু বিশেষায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই যে এমন সংকটে আছে তা নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ঊর্ধ্বতন পদে ব্যাপকহারে ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে বর্তমানে। কোনো কোনো ব্যাংকে পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। আবার কোনো ব্যাংকে প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত যোগ্য জনবল রয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্যই জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) পদে পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন এনে পূর্বেকার ‘পুল’ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু চারমাসও যুগোপযোগী এ নীতিমালাটি বহাল রাখা সম্ভব হয়নি। দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রভাবে এ নীতিমালাটি বাতিল করে আবার সেই বিতর্কিত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
সূত্রমতে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের পদগুলোকে সাধারণত নীতিনির্ধারণী পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব পদের কর্মকর্তারাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতি-পদ্ধতি তৈরি এবং বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা রেখে থাকেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের পদে যোগ্য কর্মকর্তার সংকট থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আর্থিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনা বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এটি বিবেচনা করেই জিএম পদে পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন এনে ‘পুল’ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল।
শুধুমাত্র এই ‘পুল’ ব্যবস্থার মাধ্যমেই রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্য কর্মকর্তার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইতিপূর্বে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘকাল ধরে জিএম পর্যায়ের পদগুলোতে পদোন্নতি ও পদায়নে ‘পুল’ ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। সেই সময় জিএম পদোন্নতিতে অনেক কিছুই বিচার-বিশ্লেষণ করা হতো। পদোন্নতির সাধারণ ক্রাইটেরিয়া ছাড়াও সত্যতা, দক্ষতা, কর্মস্পৃহাসহ অন্যান্য বিষয়ও বিবেচনায় আনা হতো। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে গঠিত পুলের উচ্চ পর্যায়ের কমিটিতে প্রতিটি কর্মকর্তার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই হতো। প্রত্যেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের একত্রে হিসাবে এনে সমন্বিতভাবে পদোন্নতি এবং পদায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। যে কারণে যোগ্য কর্মকর্তার সংকট পূরণ বা জিএম পদোন্নতি-পদায়নের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। তেমনি নতুন নিয়োগেও কোনো প্রশ্ন দেখা দিতো না। কারণ সেই সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মকর্তা নিয়োগ হতো ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি (বিআরসি)র অধীনে। কিন্তু ২০০৯ সালে সেই ‘বিআরসি’ এবং ‘পুল’ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়া হয়। আর এরফলে ব্যাংকিং খাতের জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে ১৪টি। তারমধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, আইসিবি এবং বিডিবিএল- এই ৬টি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকিগুলোকে বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধুমাত্র এই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই এখন ‘পুল’ ব্যবস্থা বহাল করা হয়েছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই পুল ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে তা কাজে আসছে না। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনিতেই যোগ্য কর্মকর্তার ব্যাপক সংকট রয়েছে। যেমন, কৃষি ব্যাংকে বর্তমানে জিএম পদ খালি আছে ১৭টি। অথচ এই পদে পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা আছেন মাত্র ২ জন। আনসার-ভিডিপি ব্যাংকে জিএম পদ শূন্য আছে ২টি, কিন্তু পদোন্নতির যোগ্য একজন কর্মকর্তাও এখানে নেই। অন্যদিকে ‘পুল’ ব্যবস্থার বাইরে রাখা জনতা ব্যাংকে বর্তমানে মহাব্যবস্থাপক পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা আছেন ৪৮ জন, অথচ ব্যাংকটিতে এই পর্যায়ের পদ শূন্য আছে মাত্র তিনটি। ‘পুল’ ব্যবস্থার বাইরের অন্য বৃহৎ সোনালী ব্যাংকে আবার উল্টো চিত্র বিদ্যমান। এই প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে জিএম পদ শূন্য আছে ২৬টি। কিন্তু জিএম পদে পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা আছেন মাত্র ৯ জন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকে জিএম পদে কর্মকর্তার সংকট কাটাতে এই ব্যাংকের পদোন্নতির নীতিমালায় শিথিলতা আনা হচ্ছে। জিএম পদের ফিডার পদ অর্থাৎ ডিজিএম পদে অভিজ্ঞতার শর্ত তিন বছর থেকে কমিয়ে দু’বছর করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যদি এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটি হবে ব্যাংকিং সেক্টরে নজিরবিহীন ঘটনা। কারণ, প্রত্যেক ব্যাংকেরই পদোন্নতিতে জিএম পদের জন্য ডিজিএম পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত বহাল রয়েছে। অতীতে বরাবর এই নিয়মেই পদোন্নতি হয়ে আসছে। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের জারি করা পদোন্নতির নীতিমালায়ও অভিজ্ঞতার শর্ত তিন বছরই বহাল আছে। অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করার অর্থই হলো অযোগ্য কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে উপরের পদে বসানো। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ মোটেই রক্ষা করা হয় না।
দেশের প্রধান চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয় ২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর। সেই পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ব সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমুহে নতুন নিয়োগ হতো বিআরসি (ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি) এর মাধ্যমে। মহাব্যবস্থাপক, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতি-পদায়ন হতো পুলের মাধ্যমে। কিন্তু লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিআরসি এবং ‘পুল’ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এরফলে জিএম (মহাব্যবস্থাপক) পর্যন্ত নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি সংক্রান্ত সার্বিক কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট ব্যংকের হাতে চলে যায়। সেই থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন জনবল নিয়োগ এবং পদোন্নতি-পদায়নকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি-অনিয়ম ও ব্যাপক ঘুষ লেনদেনের প্রথা চালু হয়। নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নে রাজনৈতিক চাপ এবং তদবির এতো বেড়ে যায় যে স্বাভাবিক কাজকর্মেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
এসব নিয়ে এক পর্যায়ে কেলেংকারি কা- বেধে যায়। প্রতিটি নতুন নিয়োগে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠে। এমনকি পদোন্নতিতেও বড় অংকের ঘুষ বাণিজ্য হয়। জিএম পদোন্নতিতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। ব্যাপক সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব এই কমিটির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি বা বিআরসি গঠনের মধ্য দিয়ে নতুন জনবল নিয়োগে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা গেলেও জিএম পদে পদোন্নতি-পদায়নে ঘুষ লেনদেনের প্রথা থেকেই যায়। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলোতে যোগ্য কর্মকর্তারও সংকট দেখা দেয়। অথচ জিএম পদ ব্যাংকিং সেক্টরে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদে পদোন্নতি-পদায়নে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা অতি জরুরি। তাছাড়া কোনো ব্যাংকে জিএম পদে যোগ্য কর্মকর্তার সংকট থাকলে ওই ব্যাংকের পক্ষে সার্বিক কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। এসব বিবেচনা করেই গত ১৭ জুলাই, ২০১৯ নতুন নীতিমালা জারি করা হয়। এই নীতিমালার অধীনে ‘পুল’ ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে এই পুল ব্যবস্থা গঠন করা হয়। ‘পুল’এর অধীনে পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ইতিমধ্যে শূন্য পদ ও যোগ্য কমকর্তার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। অর্থাৎ এ ব্যাপারে পূর্ণ প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছিল।
কিন্তু সেই দুর্নীতিবাজ চক্রের অপতৎপরতার কারণে ‘পুল’ ব্যবস্থাটি অবশেষে কার্যকর করা গেলো না। প্রভাবশালী মহল ঘুষ-দুর্নীতি অব্যাহত রাখার জন্য সরকারের উপরের মহলে প্রভাব খাটিয়ে নতুন একটি প্রজ্ঞাপন জারির ব্যবস্থা করে। গত ১১ নভেম্বর, ২০১৯ ইং তারিখে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জারি করা এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘পুল’ ব্যবস্থা আবারও বাতিল করা হয়। অথচ মাত্র চার মাস আগে গত জুলাইয়ে এই ‘পুল’ ব্যবস্থা বহাল করা হয়েছিল। এখন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালীসহ ৬টি বড় প্রতিষ্ঠানকে বাইরে রেখে বাকি ৮টি প্রতিষ্ঠানে ‘পুল’ ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু কেন মাত্র চার মাসের মাথায় নীতিমালায় আবার পরিবর্তন এনে এই ৬টি প্রতিষ্ঠানকে ‘পুল’ ব্যবস্থা থেকে বাইরে রাখা হলো এর কোনো যুক্তি সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সোনালী ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজদের বিশেষ সুবিধা দিতেই তিনি সরকারের উপরের মহলে প্রভাব খাটিয়ে নতুন এই প্রজ্ঞাপন জারিতে ভূমিকা রেখেছেন। আতাউর রহমান প্রধানকে বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও ইতিপূর্বে রূপালী ব্যাংকের এমডি পদে থাকাকালে ব্যর্থতা এবং নানা অনিয়মে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে তারপরও ‘পুরষ্কার’ স্বরূপ তাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান- সোনালী ব্যংকের এমডি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ৬ জানুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন