'DHAKA-400 Years History in Photographs' নামে ফেসবুকের একটি গ্রুপে ঢাকা শহরের পুরনো বিভিন্ন স্থাপনা, রাস্তা-ঘাট, বাসা-বাড়ি ও অনেক ঘটনার স্থিরচিত্র পোস্ট করা হয়। ওই ছবিগুলোর সঙ্গে এখনকার ঢাকাকে মেলানো যায় না।
আগের ছবিগুলোতেই ঢাকার ভারিক্কি, সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনেক বেশি ফুটে উঠছে। সে পরিবেশ তো ধরে রাখাই যাচ্ছে না বরং প্রতিনিয়ত এ শহরটি ঘিঞ্জি হয়ে যাচ্ছে। ইট, বালু, সিমেন্ট ও লোহা-লক্কড়ের আবর্জনায় ভরে উঠছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিন ঢাকা শহরে হাজার হাজার লোক আসছে। যেখানে-সেখানে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, উঠবেই তো। তাদেরও তো বাসস্থান দরকার। শহরের আয়তন সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি করা যায়নি, তাই উল্লম্ব বর্ধন ছাড়া উপায় নেই।
আগে রাস্তার ধারের একতলা-দোতলা বাড়িগুলো এখন ৬তলা, ১০তলা, ১২তলা বিল্ডিংয়ে পরিণত হয়েছে। যে মহল্লায় আগে ৫ হাজার লোক বাস করত, এখন সেখানে লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।
রিকশা, মোটরসাইকেল ও যানবাহনে রাস্তাগুলোর জ্যামপ্যাক অবস্থা। মানুষের গায়ে গায়ে লেগেও হাঁটা যায় না। আকাশমুখী বর্ধনের কারণেই হয়তো জনজীবনে নেমে আসছে যন্ত্রণা ও ভোগান্তি।
আমাদের শহরগুলো তো আবাসিক, বাণিজ্যিক, দাফতরিক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। একটির গা ঘেঁষে আরেকটি স্থাপনা গড়ে উঠছে। অনেক বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি ও কোনো কোনো কক্ষে সূর্যের আলো ঢোকার কোনো ব্যবস্থা নেই।
সরু, অন্ধকার, নোংরা, স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি বেয়ে মানুষজনকে ওঠানামা করতে হচ্ছে। বাণিজ্যিক বিল্ডিংগুলোর ভেতরের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, একেকটা ফ্লোরকে পার্টিশন দিয়ে বানানো ছোট ছোট খুপরিতেই কর্মজীবীদের সারা দিন কাটাতে হয়।
ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮-এর ২৮ নং উপবিধি মতে অনিরাপদ, জরাজীর্ণ, অস্বাস্থ্যকর, অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ, যথাযথ জরুরি নির্গমন পথবিহীন, ভগ্ন প্রায়, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণাহীন, পরিত্যক্ত, অধিবাসী ও সংলগ্ন এলাকার জনসাধারণের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত যে কোনো ইমারত বা নির্মাণকাজ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হবে।
সত্যিই দুর্ভাগ্য, প্রিয় এ মহানগরীতে আমাদের দিবানিশি ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে। অবাক করার বিষয়, কোনো কোনো উঁচু বিল্ডিংয়ে একটি মাত্র সিঁড়ি রাখা হয়েছে, যা দিয়ে কখনই রিস্ক কভার করা যায় না। সিঁড়ির দিকেই কোনো বিপদ ঘটে গেলে মানুষের বের হওয়ার কোনো বিকল্প পথই থাকবে না।
প্রত্যেক বহুতল স্থাপনায় মানসম্পন্ন একাধিক সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিঁড়ির কোনো অংশকে কখনই ময়লা-আবর্জনা, ভাঙাচোরা আসবাবপত্র রাখার জায়গা বা স্টোর রুমে পরিণত করা যাবে না।
অনেক স্থাপনার নিচতলায় গ্রিল তৈরির কারখানা, দু’তলায় কমিউনিটি হল, তিনতলায় খাওয়ার দোকান, চারতলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঁচতলায় অফিস, ছয়তলায় আবাসিক ফ্ল্যাট। কোনো পরিকল্পিত নগরীতে এত বিচিত্র উদ্দেশ্যসংবলিত স্ট্রাকচার থাকার কথা নয়।
সাধারণত কোনো প্লটের সামনের রাস্তার প্রশস্ততা ওই প্লটে কোনো স্থাপনার সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারণে বিবেচ্য একটি বিষয়। কিন্তু যে রাস্তা এখনই ট্রাফিক জ্যাম ও জনমানুষের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে, সে রাস্তার পাশে যদি একটির পর একটি সুউচ্চ দালান উঠতেই থাকে, তা হলে ওই রাস্তা তো আর চলাচলের উপযুক্তই থাকবে না। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
এ ভোগান্তি দূর করতে কোনো এলাকায় সর্বোচ্চ যত উচ্চতার স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি আছে এবং ভবিষ্যতে ওই প্লটে সে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধাগুলো স্থাপনা তৈরির সময়ে একইসঙ্গে সেই প্লটে প্রদান করা যেতে পারে। যেন বারবার রাস্তা কাটাকাটি, খোঁড়াখুঁড়ি করে অনির্ধারিত সময় ধরে জনভোগান্তি জিইয়ে রাখতে না হয়।
একই রাস্তার ধারে সারা বছর বিভিন্ন স্থাপনা তৈরিতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোনসহ অন্যান্য সেবা প্রদান ও তা অব্যাহত রাখতে কয়েকদিন পরপর রাস্তা কাটা ও মেরামতের কারণে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য চলাচল কঠিন হয়ে পড়ছে।
‘নির্মাণ প্রকল্পের দ্রব্যাদি ও জিনিসপত্র জনপথে কিংবা ফুটপাতে রেখে জনসাধারণের চলাচলে অসুবিধা তৈরি করা যাবে না’- আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকার কোথাও এ আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী অন্যূন সাততলার ওপর যে কোনো ভবনই বহুতল। আর রাজউক অনুসৃত আইন অনুযায়ী ১০তলা বা তদূর্ধ্ব ভবন বহুতল। ফলে রাজউক ১০তলার নিচের ভবনের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র চায় না।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে ‘অনুমোদিত অগ্নিনিরাপত্তা’ ব্যবস্থা ছাড়াই গড়ে উঠছে অসংখ্য ভবন। বহুতল ভবনের এ সংজ্ঞার পার্থক্যকে সমন্বয় করতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে অসংখ্য ভবনে অগ্নিঝুঁকির জটিলতা আরও বাড়তেই থাকবে।
আগে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণে নিজের ও উত্তরাধিকারীদের ভোগ ও ব্যবহারের বিষয়টি মুখ্য হতো, তাই অত্যন্ত সাবধানতা ও সতর্কতার সঙ্গেই কাঠামোগুলো গড়ে উঠত। সময় পাল্টাচ্ছে, বাড়তি লাভের ব্যবসায়িক হিসাব অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠছে।
রাস্তা, ব্রিজ, বিভিন্ন ধরনের স্থাপনায় পিলার, বিম, লিনটেইল নির্মাণে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশের ফালি বা কঞ্চি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোহার শিক ছাড়া শুধু খোয়া, বালি, সিমেন্ট দিয়েই ঢালাই কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। অনেক স্থাপনা নির্মাণে প্রয়োজনের তুলনায় কম উপকরণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে।
আতঙ্কিত হতে হয়, নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই সেগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে সংকট তৈরি করবে কিনা? বহু অখ্যাত কোম্পানি নির্মাণকাজে ঢুকে পড়েছে। তাদের দায়বদ্ধতার মাত্রা ক্রেতাসাধারণকে সন্তুষ্ট করতে পারছে বলে মনে হয় না। বিল্ডিং কোড না মেনে ও নিুমানের উপকরণ দিয়ে স্থাপনা নির্মাণে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কিছু বোঝা যাবে না।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে যদি ব্যাপকভিত্তিক ক্র্যাকডাউন শুরু হয়, তাহলে হা-হুতাশ করারও কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই স্থাপনা নির্মাণে উপকরণ সামগ্রীর মান ও মিশ্রণের অনুপাত যথাযথ হচ্ছে কিনা, তা মেইনটেন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমার এক পরিচিত জন ছয়তলার ফাউন্ডেশন দিয়ে ৮তলা করেছেন।
তাকে জিজ্ঞেস করায় জবাবে বললেন, এ প্লটে আগে কোনো পুকুর বা ডোবা ছিল না, মাটি অনেক শক্ত, কোনো অসুবিধা নেই। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মতামত বিতরণে আমরা অনেক সময় পুরোদস্তুর বিশেষজ্ঞ বনে যাই।
মনে রাখতে হবে, এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কেবল বাড়তেই থাকবে। আর তাই তো সাভারের স্পেকট্রাম গ্যার্মেন্ট বিল্ডিং, রানা প্লাজা ও অনেক স্থাপনা ভেঙে পড়ার ঘটনা আমাদের ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলোতে সাধারণত অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা গুনে সমপরিমাণ গাড়ির পার্কিং প্লেস রাখা হয়। অতিথিদের গাড়ি ভেতরে রাখার কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
একটি বিল্ডিংয়ে ৩৬টি অ্যাপার্টমেন্টের সবগুলোতে একইসঙ্গে গাড়ি নিয়ে অতিথি এলে বিল্ডিংয়ের সামনে রাস্তার পাশে ৩৬টি গাড়ি কি পার্ক করে রাখা যাবে? এর কোনো সমাধান এখনও নেই।
আমরা এখন ওয়ানটাইম ইউজেবল যুগে প্রবেশ করেছি, একবার বা এক মেয়াদের ব্যবহারে তার স্থায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ঢেউ আছড়ে পড়ছে ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতিতেও। এসি, লিফট, বৈদ্যুতিক তার, সুইচ, প্লাগ, সকেট সবকিছু অল্প দামে পাওয়া যাচ্ছে, দেখতেও সুন্দর লাগছে।
এগুলো কিন্তু বেশিদিন টেকসই হচ্ছে না, নিরাপদও নয়। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং ও বিভিন্ন স্থাপনায় এগুলো দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই তো শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিকাণ্ড, এসি বিস্ফোরণ, লিফট ছিঁড়ে জানমালের ক্ষতির খবর প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতা দখল করছে।
ঢাকা শহরে ২৫-৩০ বছর আগেও একতলা-দোতলা বাড়ির সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে প্রচুর গাছগাছালি দেখা যেত, সে বাড়িগুলো আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ে পরিণত হতে থাকায় বৃক্ষশূন্য হতে লাগল আমাদের বাসা-বাড়ির আশপাশ। ফলশ্রুতিতে পরিবেশের ভারসাম্য হতে লাগল বিঘ্নিত।
আমাদের দেশের উঁচু দালানগুলো পরিবেশবান্ধব হিসেবে নির্মাণ করতে হবে। গত ২৫ আগস্ট ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ আয়োজিত টেকসই পরিবেশ ও স্বীকৃতি সনদবিষয়ক অংশগ্রহণমূলক সংলাপে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রণোদনা দেয়া উচিত, যা দেশের জলবায়ুতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নগরের বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড় সমন্বয় ও বড় বড় শহরের পাশাপাশি উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়েও উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকা শহর জনমানুষে গিজ গিজ করছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করতে সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে এ শহরের ঘিঞ্জি ও জনবহুল এলাকাগুলোতে ভবন নির্মাণে সব শর্ত কেউ প্রতিপালন করতে পারলেও আর কোনো বহুতল ভবন নির্মাণে যৌক্তিকতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে।
রাজধানীর বাইরে একটু খোলামেলা জায়গায় গেলেই প্রস্তাবিত বহু হাউজিং এস্টেট ও স্যাটেলাইট সিটির মনোলোভা সাইনবোর্ড নজরে আসে। কিন্তু বহু বছর পার হয়ে গেলেও ‘প্রস্তাবিত’ ওইসব আবাসনে উল্লেখ করার মতো কোনো বসতিই গড়ে ওঠেনি।
নগরমুখী চাপ কমাতে ওইসব এলাকার ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও বেসরকারি আবাসনগুলোতে জনগণের আস্থা সৃষ্টির দৃশ্যমান উদ্যোগ নিতে হবে। স্বস্তিকর, নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন বসবাসের জন্য বহুতল ভবনের বদ্ধ পরিবেশ থেকে জনমানুষকে মহানগরীর চারদিকে ছড়িয়ে দিতে জোরেশোরে উদ্যোগ নিতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন