সিএনজি চালকের আড়ালে ভয়ঙ্কর ‘কিলিং মিশন চক্র’!
কিলিং মিশন চক্রের গ্রেফতার তিন সদস্য
রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভারের উপর সোনারগাঁও রেলক্রসিং বরাবর পড়ে আছে এক যুবকের মরদেহ। পাঁচ জানুয়ারি রবিবার রাতে হাতিরঝিল থানার অফিসিয়াল নম্বরে অজ্ঞাত পরিচয়ে ফোন করে জানান এমন ঘটনা। মুহূর্তে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ উপস্থিত। দেখতে পান একটি যুবকের নিথর দেহ। মৃতের সারা শরীরে নেই কোন আঘাতের চিহ্ণ তবে আছে ঠোঁট বেয়ে ঝড়া একছোপ রক্ত।
মরদেহের পড়ে থাকা পুরো এলাকা খোঁজে সনাক্তকরণে মেলেনি কোন আলামত। তবে সামান্য এগোতে ফ্লাইওভারের রেলিং ওয়াল ঘেঁষে পাওয়া যায় একটি মানিব্যাগ। ব্যাগে পাওয়া গেল একটি জাতীয় পরিচয় পত্র ও চাকরির আইডি কার্ড। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ডের ছবির সাথে মিলানো হলো মৃতদেহের ছবি। সনাক্ত হলো মৃতদেহটি।
মৃত যুবক ছেলেটির নাম মিজানুর রহমান। বয়স ২৫ বছর। লক্ষীপুর জেলার সদর থানাধীন ছবিলপুর গ্রামে তার জন্ম। তার বাবা আমির হোসেন পেশায় মুদি দোকানদার।
বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমান শেওড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতো। পড়াশোনার পাশাপাশি বনানীতে অবস্থিত হোটেল ‘গোল্ডেন টিউলিপ’ এর ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ শাখায় ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন। নিজের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা পাঠাতো গ্রামে। মুদি দোকানদার বাবাকে।
এদিকে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোন, হাতিরঝিল থানার বিশেষ তত্বাবধানে একটি টিম (২৩ জানুয়ারি) রাতে টঙ্গী এলাকা থেকে নুরুল ইসলাম এবং (২৫ জানুয়ারি) গাজীপুরা ও তুরাগ এলাকা থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালালকে গ্রেফতার করে।
পুলিশে দেওয়া তথ্য সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম মূলত সিএনজি চালক। সিএনজি চালনার আড়ালে তার মূল পেশা ছিনতাই। নুরুল ইসলামসহ আরও আটজন মিলে তারা গড়ে তুলেছে সিএনজি কেন্দ্রীক দুটি ভয়ংকর ছিনতাই ও কিলিং গ্রুপ। রাত আটটার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাডডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, সাইনবোর্ড এলাকা চলতে থাকে তাদের অপকর্ম।
গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম জানিয়েছে, সে ৫ থেকে ৬ মাস ধরে প্রায় ৬০০ ছিনতাই করেছে। তার সহযোগী ৫-৬ জন আছে যারা প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর ধরে ছিনতাই করছে। অনেকেই ২০০০-২৫০০ ছিনতাই করেছে। রাত আটটায় বের হয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত কমপক্ষে একটি থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি পর্যন্ত ছিনতাই করার রেকর্ড আছে।
জিজ্ঞাসাবাদে নূরুল ইসলাম, জালাল ও আবদুল্লাহ বাবু যে তথ্য দিয়েছে তা রীতিমতো লোমহর্ষক।
এরআগে গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইওভারে পাওয়া গেছে চারটি লাশ। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। সবার গলায় গামছা বা মাফলার পেচিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
গত ১০ ডিসেম্বর আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্নকারকে হত্যার পর মরদেহ ফেলে রাখা হয় কুড়িল ফ্লাইওভারে। ৩১ ডিসেম্বর খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে উঠার পথের ডানপাশে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন ফ্লাইওভারে মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর মিজানুর রহমানের মরদেহ পাওয়া যায়।
গ্রেফতারকৃত নূরুল ইসলাম ও তার সহযোগী দুই ছিনতাইকারী চারটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে নূরুল ইসলাম। মূলত সিএনজিতে যাত্রী হিসেবে উঠিয়ে ছিনতাইয়ে বাঁধা দেওয়ায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্রের বাইরে দুটি এলাকায় গত দুই মাসে তারা আরো ০৪ টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নূরুল ইসলাম স্বীকার করেছে।
পাশাপাশি ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান অথবা মারাত্মক গুরতর অবস্থায় ৩০-৪০ জন জন যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে সিএনজি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেছে নূরুল ইসলাম। এদের মধ্যে ৮ থেকে ১০ জন বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।
এ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলেও জানায় পুলিশ।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন