রাজধানীর কুর্মিটোলায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ঢাবি ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মজনুকে ঘিরে নানা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এই ঘটনায় আসলেই প্রকৃত দোষীকে আটক করা হয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। গ্রেফতারকৃত মজনুর ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এটিকে আরেকটি জজ মিয়া নাটক বলে আখ্যা দিয়েছেন। মজনু নামের এই ব্যক্তিকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসতে যেসব প্রটোকল এবং যেভাবে লাইভ প্রচার করা হয়েছে সেটি রীতিমতো মাছি মারতে কামান দাগানোর মতো বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। মজনু আসল ধর্ষক কি না তা নিয়ে জনগণ প্রশ্ন তুলেছে বলে দাবি করেছেন ডাকসুর ভিপি নূরুল হক নূর। নূরের মতো মজনুকে নিয়ে সন্দেহের কথা বলেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। মজনু যেন জজ মিয়া কাহিনী না হয়- এমন মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এই ঘটনাকে ‘রেশমা নাটক’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল।
সর্বশেষ, ৭ দিনের রিমান্ড শেষে গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে খাস কামরায় মজনু এই মর্মে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যে, সে ঢাবির ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। তারপরও সবাই যেন এত ‘কিন্তু’ খুঁজছে। মজনুর এই স্বীকারোক্তিকেও সন্দেহের চোখে দেখছেন বেশিরভাগ মানুষ। মজনু যে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে, এটা কেউ মানতে বা বিশ^াস করতে চাচ্ছেন না। অবশ্য এরও কিছু কারণ রয়েছে।
এদিকে মজনুর প্রকৃত পরিচয় নিয়েও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মজনুর যে পরিচয় প্রকাশ করেছে তার কোনো সত্যতাই খুঁজে পায়নি স্থানীয় প্রশাসন। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থার অভাব থেকেই ধর্ষণের ঘটনায় মজনুকে গ্রেফতার নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্য থেকে এই ইস্যুতেও বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। মজনুকে গ্রেফতারকারী সংস্থা র্যাবের দাবি, ভিক্টিম নিজেই ছবি দেখে শনাক্ত করেছে মজনুই তার ধর্ষক। কিন্ত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ইতিপূর্বে ওই শিক্ষার্থীর যে ভাষ্য তুলে ধরা হয়েছে তার সাথে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কোনো মিল নেই। শিক্ষার্থীর দেওয়া সাক্ষাৎকারে ধর্ষকের চেহারার যে বর্ণনা উঠে এসেছে তাতে বোঝা যায়- ধর্ষক বেশ সুঠামদেহী ও তার আচরণেও বেশ প্রভাবশালী বা দাম্ভিক ভাব ছিলো। কিন্তু গ্রেফতারকৃত মজনুর শরীর পাতলা গড়নের। র্যাব বলছে, মজনু মাদকাসক্ত এবং ছিনতাই, রাহাজানি ও চুরির মতো অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত। এমন অবস্থায় বিভিন্নমহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে-মজনুই কি আসল ধর্ষক? নাকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে এই কৌশল?
ঢাবির ধর্ষিতা ছাত্রী ঢাকা মেডিকেলে পুলিশ, শিক্ষক ও মানবাধিকার সংস্থার কর্মীদের কাছে ধর্ষকের বর্ণনা দিয়েছেন যে, লোকটি ছিল শ্যামলা বর্ণের, মাথার চুল ছোট, পরনে জিন্সের প্যান্ট ও গায়ে জ্যাকেট এবং খুব ধাম্ভিক ছিল। মেয়েটিকে সে পেছন থেকে ঘাড় ধরে রাস্তার পাশ থেকে ঝোপের ভেতর নিয়ে যায়। এমনকি তাকে পরনের কাপড় পরিবর্তন করতেও বাধ্য করে। বার বার তার নাম জানতে চেয়েছে। মেয়েটি ভয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেনি। মেয়েটির মনে হয়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিচয় পেলে তাকে মেরে ফেলা হবে। তবে দেখা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষক সন্দেহে মজনু নামে যাকে আটক করেছে তার চেহারা, মাথার চুল, শরীরের কাঠামো, পোশাক কোনো কিছুই মেয়েটির বর্ণনার সঙ্গে মিলেনি।
এমন অবস্থায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে ধর্ষকের গ্রেফতার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো সেই আন্দোলন থামাতে ও সরকারের ইমেজ ধরে রাখতেই কি এই গ্রেফতার নাটক হয়েছে? নাকি আসল ধর্ষককে আড়াল করতে কথিত এই মজনুকে গ্রেফতার করে মানুষের সামনে হাজির করা হয়েছে। মজনুকে দেখার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারাও সন্দেহ প্রকাশ করে বলছে-সরকার পরিকল্পিতভাবে মজনুকে দিয়ে আরেকটি জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কীভাবে একজন ভবঘুরে ধর্ষণ করতে পারেন? ধর্ষকের শরীরের গড়ন দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটির ওপর জোর খাটানোর মতো শক্তি তার নেই। ধর্ষক ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। ধর্ষণের শিকার ছাত্রীটি বলেছেন, ধর্ষক বেশ দাম্ভিকও, তিনি মেয়েটি কোথায় পড়েন, তা জানতে চেয়েছেন। সেই ধর্ষকের জোর থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। সেদিক থেকে খটকা লেগেছে অনেকের। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে এগুলো জিজ্ঞাসা করা সম্ভব কি না? একজন ভবঘুরের, কিছুটা দেখতে ‘অপ্রকৃতিস্থ’ ব্যক্তির এতটা সাহস হওয়ার কথা নয়, এসব মন্তব্যও এসেছে।
নোয়াখালীতে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি মজনুর
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ঢাবি ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার মজনুর যে পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে তা নিয়েও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। মজনুর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা হিসেবে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়ন উল্লেখ করা হলেও সেখানে তার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ১০ জানুয়ারি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকপত্রিকা। জাহাজমারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাছুম বিল্লাহর বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়-“চেয়ারম্যান জানান, পুলিশ ও সাংবাদিকের ফোনে অতিষ্ঠ হয়ে দুই দিন ধরে ৯ ওয়ার্ডের ৭ মেম্বার ও চৌকিদার, দফাদার নিয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পর হাতিয়ার-জাহাজমারা গ্রামে মজনু, পিতা- মৃত মাহফুজুর রহমান, মাতা- সখিনা খাতুন নামে কাউকে পাইনি। ১২ বছর আগের তথ্য ইউনিয়ন পরিষদে নেই। স্ত্রী মারা গেছে, বাবা মারা গেছে, মা দেশের বাড়িতে থাকে। এ ধরনের কোন অস্তিত্ব নেই। স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক দিলদার উদ্দিন জানান, বহুল আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো জজ মিয়া নাটকের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। হাতিয়া প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি ইসমাইল হোসেন কিরন জানান, আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা সরেজমিন অনুসন্ধান করে ধর্ষক মজনুর কোন ঠিকানা আবিষ্কার করতে পারিনি। হাতিয়া প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি ফিরোজ উদ্দিন জানান, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও ক্যামেরাম্যানদের নিয়ে হাতিয়ার জাহাজমারার ৯নং ওয়ার্ডের মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালেও এ ধরনের নাম, ঠিকানা জীবনে কোনদিন শুনেননি বলে জানান। হাতিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আবুল খায়ের জানান, আমরা দুদিন ধরে শুধু জাহাজমারা নয়, পুরো হাতিয়ায় ধর্ষক মজনুর নাম-ঠিকানার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও ওই ঠিকানায় ওই নামের কাউকে পাইনি।”
গ্রেফতারের আগে একাত্তর টিভির ক্যামেরায় মজনু
ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষককে গ্রেফতারের দাবিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যখন উত্তাল ঠিক তখনই ৮ জানুয়ারি মজনুকে গ্রেফতারের কথা জানায় র্যাব। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম জানান, ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোন ও ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিল ধর্ষক, যার সূত্র ধরে ৭ জানুয়ারি দুইজনকে আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৮ জানুয়ারি ভোর পৌনে ৫টায় শেওড়া রেল ক্রসিং এলাকা থেকে মজনুকে র্যাব গ্রেফতার করে। কিন্তু একাত্তর টিভির একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে গ্রেফতারের একদিন আগে অর্থাৎ ৭ জানুয়ারি সকালে যখন আইনৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান তখন মজনু ঘটনাস্থলের আশপাশেই ঘুরাফেরা করছিল। এই বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
‘ধর্ষক’ মজনুকে নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভিপি নূরও
ছাত্রী ধর্ষণে গ্রেফতার মজনুকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাজন যে সংশয় প্রকাশ করেছেন, তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ডাকসুর ভিপি নূরুল হক নূর। ৯ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে পদযাত্রা’ শীর্ষক কর্মসূচিতে তিনি এই সংশয়ের কথা জানান। নূর বলেন, “ধর্ষকের গ্রেফতারে অসংখ্য মানুষ আছে যারা প্রশ্ন তুলেছে, এটি আসল ধর্ষক নাকি এটি আরেকটি ‘জজ মিয়া নাটক’। মানুষের যেহেতু কনফিউশন তৈরি হয়েছে, মানুষের যেহেতু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, এই প্রশ্নের সমাধান করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই।” তিনি বলেন, “এই ধর্ষক যে প্রকৃত ধর্ষক সেটি প্রমাণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।”
‘ধর্ষক’ মজনুকে নিয়ে সন্দেহে মান্নাও
নূরের পর ‘ধর্ষক’ মজনুকে নিয়ে সন্দেহের কথা বললেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্না প্রশ্ন করেছেন, “ওই রকমের একটা দুর্বল শরীরের মানুষ একটা মেয়েকে ধরে একা একা ধর্ষণ করতে পারে? আসলে এটা কি সম্ভব?” তাকে ধরে ‘কাহিনী সাজানো হচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, তারা আর কোনো ‘জজ মিয়া’ নাটক দেখতে চান না। ১১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উদ্যোগে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধনে মান্না এ কথা বলেন। তিনি বলেন, “মানুষের কাছে প্রশ্ন উঠেছে, যে ধর্ষণ করল তাকে গ্রেফতারের পর তার ছবি দেখে, চেহারা দেখে, সামনে দুইটা দাঁত নাই- এ রকমের একটা বিদঘুটে অবস্থা- এই লোকটাই কি সত্যি ধর্ষক? সোশাল মিডিয়াতে প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। সাধারণ যে কাউকে জিজ্ঞাসা করেন, ওই রকমের একটা দুর্বল শরীরের মানুষ একটা মেয়েকে ধরে একা একা ধর্ষণ করতে পারে? কোনো মেয়ে যদি মনে করে আমি ধর্ষণ করতে দেব না, একা কোনো মানুষ, আসলে এটা কি সম্ভব?”
ডা. জাফরুল্লাহ যা বললেন
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ঢাবি শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে একজন মজনু আবিষ্কার হয়েছে। মজনু মিয়া যেন জজ মিয়া কাহিনীর মতো না হয়। যদি জজ মিয়া কাহিনীর মতো হয়, তাহলে দেশে যে হারে ধর্ষণ হচ্ছে তার সমাধান হবে না। ৯ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘গণতন্ত্র উদ্ধার আন্দোলন’-এর আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে এক মানববন্ধনে তিনি এসব কথা বলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের পাশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দেশে এত গোয়েন্দা সংস্থা, তারা কী করে। তারা কি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে? জনগণকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নাই?’ তিনি বলেন, ‘সেই ধর্ষণের অভিযোগে একজন মজনু মিয়া আবিষ্কার হয়েছে। সেই মজনু মিয়া যেন জজ মিয়া কাহিনীর মতো না হয়। জজ মিয়া কাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না।’
ধর্ষক গ্রেফতারকে ‘রেশমা নাটক’ বললেন আসিফ নজরুল
ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণকাণ্ডে মজনু নামের ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ঘটনাকে ‘রেশমা নাটক’ বলে মন্তব্য করেছেন একই বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। ৯ জানুয়ারি নিজের ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাবির আইন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘অভিযোগ রয়েছে যে রেশমা উদ্ধার নাটক করা হয়েছিল হেফাজতের সমাবেশে হামলাকে আড়াল করার জন্য। তারপর দিনে দিনে মিথ্যার পাহাড় এতো উঁচু হয়েছে যে সত্য কথা বললেও মানুষ আর বিশ্বাস করে না তাদের।’ ‘ধর্ষণের অভিযোগে মজনু গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে তা আবার দেখা গেল’, যোগ করেন আসিফ নজরুল।
কেন এই বিতর্ক?
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে, সেকারণে এখন আলোচিত ধর্ষণের ঘটনায় একজনকে গ্রেফতারের পরই তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্য থেকে এই ইস্যুতেও বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু কেন এই বিতর্ক? বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ যারা সন্দেহ প্রকাশ করছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন একজন শিক্ষার্থী বলছিলেন- ধর্ষণের শিকার ছাত্রীটিকে উদ্ধৃত করে অভিযুক্ত সম্পর্কে অনেক বর্ণনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল, তার সাথে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে মিলাতে গিয়ে তার সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেছেন, অতীতে বিভিন্ন মামলায় আসল মানুষকে না ধরে অন্য ব্যক্তিকে গ্রেফতারের অনেক উদাহরণ আছে। সেকারণেও এখন গ্রেফতারকৃতকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বলে তিনি মনে করেন। সন্দেহ প্রকাশকারী এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, “আমরা আগে দেখেছি, অভিযুক্ত না হয়েও জাহালম নামের একজন ব্যক্তি একটি মামলায় ১০ বছর কারাগারে ছিলেন। এরকম উদাহরণগুলোতো আছে। আর নিজেদের চোখের সামনেও আসল অভিযুক্তকে বাদ দিয়ে অন্যকে গ্রেফতারের অনেক ঘটনা ঘটেছে। ফলে পুলিশের ওপর আমরা ভরসাটা করি কিভাবে?” তিনি আরও বলেছেন, “মেয়েটির যে বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, সেখানে দাম্ভিক ব্যক্তির কথা এসেছে। তাতো মিলছে না। এখানেই সন্দেহ হচ্ছে।”
মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে এমন বিতর্কের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থার অভাবকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন। তারা বলেছেন, অতীতে আসল অভিযুক্ত ধরা না পড়ার অনেক ঘটনা উদাহরণ হয়ে আছে। সে কারণে সংকট বেড়েই চলেছে।
তবে বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন পুলিশের সাবেক একজন আইজি নুরুল হুদা। তিনি বলছিলেন, ধর্ষণের মামলায় অল্প সময়ের মধ্যে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ঘটনা হাতেগোনা এবং সেটিই এখন সন্দেহ সৃষ্টি করছে বলে তিনি মনে করেন। তবে এই বিতর্ক সৃষ্টির পেছনেই কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে পুলিশ ধারণা করছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বিবিসিকে বলেছেন, এখন গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজনকে নিয়ে বিতর্ক করার কোনো সুযোগ না থাকলেও তা করা হচ্ছে। “এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ আমরা ঘটনাস্থলটাকে যেভাবে দেখেছি। ভিক্টিমের যে বক্তব্য শুনেছি এবং তার একটি ফোন পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই ফোনের সূত্র ধরে এবং আমরা কিছু ম্যানুয়েল সোর্স কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আসামিকে ধরেছে। সেই আসামিকে ভিক্টিম শনাক্ত করেছে।” তিনি আরও বলেছেন, “যারা এসব বিতর্ক তুলছেন বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে, এই সামাজিক মাধ্যম যারা ব্যবহার করছেন তারা ঘটনাস্থলের আশে পাশে নাই। আমি বলবো, তারা সরকারকে বিব্রত করতে চান। পুলিশকে বিব্রত করলে সরকারকে বিব্রত করা হবে, হয়তো কেউ কেউ এই মনমানসিকতা নিয়ে এ ধরনের বিতর্ক তুলছেন।” পুলিশের কর্মকর্তারা অবশ্য বলেছেন, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির ডিএনএ টেস্টসহ ফরেনসিক কিছু বিষয়ে আরও পরীক্ষা করার পর তারা মামলাটিতে চার্জশিট দেবেন।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ২০ জানুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন