চোখের জলের কোনো রঙ নেই। তবু কত রঙ, কত গল্প বলছে কেরানীগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডে স্বজনহারাদের চোখের জল। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে। ছবি : আল আমিন লিয়ন
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলা আবাসিক এলাকায় অনুমোদন ছাড়া শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে চলছিল ‘প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামে ওয়ানটাইম প্লেট ও গ্লাস তৈরির কারখানাটি। গত ২ বছরে তিন বার প্রতিষ্ঠানটিতে আগুন লেগেছিল; মামলাও হয়েছিল মালিকের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর পরও টনক নড়েনি।
অভিযোগ আছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করেই কারখানাটি চালাচ্ছিলেন এর মালিক নজরুল ইসলাম। গত বুধবারের অগ্নিকাণ্ডের পর দগ্ধ শ্রমিকদের বাঁচানোর পরিবর্তে আইন থেকে বাঁচতে নিজেই গা ঢাকা দিয়েছেন। কারখানাটিতে কোনও ধরনের অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র ছিল না। উপরন্তু বের হওয়ার একটিমাত্র দরজা। সেখানে আগুনের লেলিহান শিখা থাকায় বের হতে পারেননি ভেতরে কর্মরতরা।
কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে ঘটনাস্থলেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান মাহাবুব হোসেন নামে (২৫) এক শ্রমিক। দগ্ধ ৩৪ জনকে বুধবার ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। তাদের মধ্যে গতরাতে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী আরও ১৩ জন মারা গেছেন।
গতকাল ঢামেক হাসপাতাল চত্বরে ভিড় দেখা গেছে হতাহতদের উদ্বিগ্ন স্বজনদের। বাবা বা ভাই কিংবা ছেলে হারানো এসব মানুষের কান্নায়, আহাজারিতে পুরো হাসপাতালজুড়ে এক শোকার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢামেকর বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধ অধিকাংশেরই ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাই তাদের সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে ৮ জনকে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়েছে।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক সামন্তলাল সেন বলেন, প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ যারা এখানে ভর্তি হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তাদের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, কেউই কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না। অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ ইনজুরি এটি। বদ্ধ ঘরের ভেতর ছিল আগুনটা। যেহেতু প্লাস্টিকের কারখানা, মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। চাকরি জীবনে এমন ভয়াবহ পোড়া রোগী আমি দেখিনি, বলেন তিনি।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন (আরএস) ডা. আরিফুল ইসলাম নবীন জানান, দগ্ধদের মধ্যে আটজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফসাপোর্টে রাখা হয়েছে। এছাড়া শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়া দশজন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭ জনই হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রয়েছেন।
সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম কারখানাটির মালিক। কারখানায় কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০০। ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, যে ইউনিটে আগুন লাগে, সেখানে ৮০ জন কর্মরত ছিলেন। গত দুবছরে এ কারখানায় তিনবার অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে, যার দুটোই চলতি বছরে। প্রতিটি অগ্নিকা-ই ছিল ভয়াবহ। বুধবারের আগুনে প্রায় ১০ হাজার বর্গফুটের কারখানাটির ভেতরের সব মালামাল ও যন্ত্রাংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস।
দুই তদন্ত কমিটি
কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর।
এছাড়া প্রাইম পেট এন্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে গত বুধরার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান এবং দুর্ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করতে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রম শাখার এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কমিটিকে আরো যেসব বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকের মাধ্যমে উক্ত এলাকাসমূহে বিগত বছরে কতগুলো প্লাস্টিক কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এ সকল পরিদর্শনের প্রতিবেদন সমূহের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কি না? না হয়ে থাকলে তার কারণসমূহ এবং ওই এলাকার প্লাস্টিক কারখানাসমূহের ঝুঁকি নির্ধারণ, ঝুঁকি নিরসনের সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন যুগ্ম সচিব (শ্রম) এটিএম সাইফুল ইসলাম, শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ঢাকার উপ-মহাপরিদর্শক আহমেদ বেলাল এবং একই অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিচালক (সেইফটি) মো. কামরুল হাসান। কমিটিকে আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্য ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছে।
গতকাল বৃহষ্পতিবার রাতে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ভয়াবহ এ অগ্নিকা- ও প্রাণহানির জেরে কোনো মামলা হয়নি। শুধু দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে।
প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের এই কারখানাটি বিধি মেনে স্থাপন করা হয়নি। প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থের কারখানায় যেসব নিয়ম মানা উচিত, তার অধিকাংশই ছিল এখানে অনুপস্থিত। প্রাথমিক তদন্তের পর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানা পরিচালনায় মালিকের অবশ্য-গাফিলতি রয়েছে। গতকাল দুপুরে অগ্নিকা-স্থল পরিদর্শনকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল হোসেন এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আবাসিক এলাকায় কারখানা করা হয়েছে। কারখানার নিরাপত্তা রক্ষায় যা যা থাকা উচিত, যে পরিবেশ রাখা উচিত, তা এখানে ছিল না।
৫ নভেম্বরই মামলা হয়েছিল মালিকের বিরুদ্ধে
যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত না করে কারখানা পরিচালনার অভিযোগে প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে গত ৫ নভেম্বর মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। বৃহষ্পতিবার সকালে অধিদপ্তরের ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোল্লা জালাল উদ্দিন জানান, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করবেন না তিনি। গতকাল ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কেরানীগঞ্জের অগ্নিদগ্ধদের অবস্থা পরিদর্শনের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, মালিকের গাফিলতির কারণেই কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকা- ঘটেছে। তাই মালিকপক্ষই ক্ষতিপূরণ দেবে। এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কাজ করবে সরকার। রাষ্ট্র দগ্ধদের চিকিৎসা দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, দগ্ধদের সবার অবস্থাই খ্বু ক্রিটিক্যাল। দুয়েকজন ছাড়া সবারই ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে। ইতোমধ্যে ঢামেকের বার্ন ইউনিট থেকে ১১ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। দরকার হলে আরও রোগী সেখানে স্থানান্তর করা হবে।
অনুমোদন ছিল না
আগুন লাগা কারখানাটির সরকারি অনুমোদন ছিল না বলে জনান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও।
কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুন নেভাতে গিয়েই অধিকাংশ শ্রমিক দগ্ধ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন অগ্নিদগ্ধ শ্রমিকেরা। তারা জানায়, ঘটনার সময় শ্রমিকরা কাজ করছিলেন। তখন হঠাৎই গ্যাস রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ইঞ্জিনিয়ার এসে শ্রমিকদের আগুন লাগার খবর দেয়। এরপর শ্রমিকরা পানি ও কারাখানায় থাকা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলে তখনই তারা দগ্ধ হয়।
অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। আহতরা পাবেন ৫০ হাজার টাকা করে। বুধবার প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রতি তিনি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। বৃহস্পতিবার এক শোক বার্তায় প্রতিমন্ত্রী এ শোক প্রকাশ করেন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক শোকবার্তায় জানানো হয়, বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী গঠিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে নিহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। আহত হয়ে যারা ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন তাদের চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজম ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন শ্রমিকদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। পরে তিনি কেরানীগঞ্জে চুনকুটিয়ার অগ্নি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। এ কারখানাটি কমপ্লাইন্স নয়। এর আগে মালিককে একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনে মামলাও করা হয়েছে। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমান সরকার এ ধরনের দুর্ঘটনার পরিমাণ শূন্যের কোটায় নিয়ে আসার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তার সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় এবং ঢাকার উপ-মহাপরিদর্শক আহমেদ বেলাল উপস্থিত ছিলেন।
গতরাত পর্যন্ত মারা গেছেন যারা, তারা হলেনÑ শ্রমিক মাহাবুব হোসেন (২৫), ইলেকট্রেশিয়ান বাবলু হোসেন (২৬), মেশিন মেনটেইনার্স মো. সালাউদ্দিন (৩৫), মেশিন অপারেটর আব্দুল খালেক খলিফা (৩৫), সিনিয়র অপারেটর জিনারুল ইসলাম মোল্লা (৩২), ইলেকট্রেশিয়ান মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৫), শ্রমিক মো. ইমরান (১৮), মো. সুজন (১৯), মো. আলম (২৫), ওমর ফারুক (৩২), রায়হান বিশ্বাস (১৬), ফয়সাল (২৯), মেহেদী হোসেন (২০) ও আব্দুর রাজ্জাক (৪৫)।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন