প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আজ খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে তাঁর স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সেই প্রতিবেদন দাখিল করেনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আরো কিছু স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা বাকি আছে বলে আদালতকে জানায় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
পরে আপিল বিভাগ আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই দিনই খালেদা জিয়ার জামিনের আপিল শুনানি করা হবে বলে আপিল বিভাগ আদেশ দেন। এর পরই আইনজীবীরা আদালতে হট্টগোল শুরু করেন।
নির্ধারিত স্বাস্থ্য প্রতিবেদন না আসায় ক্ষুব্ধ হন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের তুমুল বিতর্ক হয়। একপর্যায়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। কিন্তু বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সেখানে থেকে যান। পরে এজলাসে এসে প্রধান বিচারপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। আমরা আপিল বিভাগে এমন অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। আপনারা যা করেছেন তা নজিরবিহীন।’
সেই নজিরবিহীন ঘটনার ক্রম এখানে তুলে ধরেছেন এনটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক
সকাল ৮টা :
খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেটসহ তিনটি গেটেই কঠোর নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী অবস্থান নেয়। সারিবদ্ধভাবে পরিচয়পত্র দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশ করেন আইনজীবীরা। একইভাবে প্রবেশ করেন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তবে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি সাধারণ কোনো মানুষকে। একই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় আদালতের ভেতরে কয়েকটি প্রবেশ পথেও। আপিল বিভাগের প্রবেশ পথে বসানো হয় কয়েকটি চেকপোস্ট। আইনজীবী ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বিচারকক্ষে। তবে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়নি। এভাবে সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আদালত কক্ষে প্রবেশ করানো হয়।
সকাল ৯টা :
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেত্বত্বে ছয় বিচারপতির বেঞ্চ এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। শুরু হয় অপর কয়েকটি মামলার শুনানি। তবে শত শত আইনজীবী অপেক্ষায় বসে থাকেন খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানির জন্য। বাড়তে থাকে স্নায়ুচাপ।
বিচারকক্ষের বামপাশে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মীর হেলাল আদালত কক্ষের সামনের সারিতে বসেন। আর ডানপাশে বসেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অর্ধশাতিক আওয়ামীপন্থী আইনজীবী। বিচারক কক্ষে তখন দাঁড়ানোর মতো কোনো জায়গা ছিল না। অর্ধশতাধিক সাংবাদিক, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সাড়ে ৯টা :
এজলাসে তখন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেত্বত্বে আপিল বিভাগের ছয় সদস্য। প্রধান বিচারপতির ডান ও বাম পাশে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অপর পাঁচ বিচারপতি বসেন। একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ৯টায় খালেদা জিয়ার মামলাটি শুনানির ক্রমে আসে। পিনপতন নীরবতার মধ্যদিয়ে খালেদা জিয়ার মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।
শুনানির শুরুতেই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড, মেডিকেল বোর্ড বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ কারণে আজ রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়নি। রিপোর্ট তৈরির জন্য আরো দুই সপ্তাহ সময় প্রয়োজন।’
জবাবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড, আমাদের কাছে একটি নন-অফিশিয়াল রিপোর্ট রয়েছে। সেটি দেখে আপনি জামিন শুনানি করতে পারেন।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট আসুক, এরপর একসঙ্গে উভয় রিপোর্ট শুনাব।’
জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ রিপোর্ট দেয়নি। এ দুঃসাহস তাঁরা পায় কোথায়?’
এর প্রতিবাদ করে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এখানে দুঃসাহসের কী আছে? মেডিক্যাল বোর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে; একটু সময় চেয়েছে।’
তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, অ্যার্টনি জেনারেল যা চাচ্ছেন তাই হচ্ছে। সেই অনুসারে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বলেছেন, (খালেদা জিয়া) রাজার হালে রয়েছেন। বিচারধীন বিষয়ে এসব কথা বলার দুঃসাহস কোথায় পায়?’
এর পরই অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। একপর্যায়ে পিছন থেকে আইনজীবীরা হট্টগোল শুরু করেন। চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরিবেশ উত্তপ্ত হতে থাকে। বিচারকের কক্ষের মধ্যেই দুই পক্ষ অনেকটা মুখোমুখি হয়ে উঠে।
এই অবস্থার মধ্যেই জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে রিপোর্ট না দেওয়ায় আগামী ১২ ডিসেম্বর (আগামী বৃহস্পতিবার) এ মামলার পরবর্তী শুনানি দিন ধার্য করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেত্বত্বে ছয় সদস্যর বেঞ্চ। একইসঙ্গে ওইদিন মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা মামলার শুনানি ৮ ডিসেম্বর (আগামী রোববার) করার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু আদালত তাদের বক্তব্য গ্রহণ না করে আদেশ বহাল রাখেন।
সকাল ১০টা :
জামিন শুনানি না করার আদেশ হওয়ার প্রতিবাদে আদালতে হট্টগোল শুরু করে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। তখন প্রধান বিচারপতির এজলাসকক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপিপন্থী শতাধিক আইনজীবী স্লোগান দিতে থাকেন- ‘খালেদা জিয়ার জামিন ছাড়া ঘরে ফিরে যাব না’, ‘জামিন ছাড়া এজলাস ত্যাগ করব না’ ইত্যাদি।
তখন আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা স্লোগান বন্ধ করতে বলেন। একে কেন্দ্র করে আদালতে মুখোমুখি দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে আদালতের ভেতরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলতে থাকেন, ‘জামিন না নিয়ে আমরা এজলাস ত্যাগ করব না।’
এ সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা বিচারকক্ষে বসে পড়েন। পরে বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব না হওয়ায় একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্য এজলাস ছেড়ে খাস কামরায় চলে যান। এর পরও আইনজীবীরা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
বেলা ১১টা ৩৭ মিনিট :
এরপর বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে বিচারপতিরা আবার এজলাসে উঠেন। পুনরায় আপিল বেঞ্চের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন খালেদা জিয়ার পক্ষে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, আপনারা খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিন নির্ধারণ করেন।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। ওইদিন আসেন। আপনারা চলে যান।’
জবাবে জয়নুল আবেদীন এবং ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বলেন, মামলার দিনটা একটু এগিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী ‘রাজার হালতে’ বলার কারণেই মামলা শুনানি করা হচ্ছে না। এরপর পিছন থেকে আইনজীবীরা হৈ চৈ শুরু করে দেন।
‘বাড়াবাড়ির সীমা থাকা দরকার’
আইনজীবীদের হৈচৈয়ের একপর্যায়ে প্রধান সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমরা কাগজ দেখে বিচার করব। কে কী বলল তা দেখব না। বাড়াবাড়ির সীমা থাকা দরকার। ধৈর্যের একটি সীমা আছে। এ ধরনের নজির আর দেখিনি।’
এরপর আইনজীবীরা হৈচৈ শুরু করেন। পরে বিচার কার্যক্রম আবার বন্ধ হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেত্বত্বে ছয়জন বিচারপতি বিচারকক্ষে চুপচাপ বসে থাকেন।
একপর্যায়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবী আয়েশা আক্তার কান্নারত অবস্থায় বলতে থাকেন, ‘মাই লর্ড, হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, খালেদা জিয়ার জামিন দেন। আল্লাহর কাছেও আপনাদের একদিন জবাবদিহি করতে হবে।’
এ সময় অনেক আইনজীবী আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্না করতে থাকেন। অপরদিকে শত শত আইনজীবী স্লোগান দিতে থাকেন।
এ সময় অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসসহ অর্ধশতাধিক আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য বিচারকক্ষে ছিলেন।
১২টা ১৫ মিনিট :
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচারকক্ষে বিএনপিপন্থী শত শত আইনজীবী ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে বলে স্লোগান দিতে থাকেন। বাড়তে থাকে প্রতিবাদও। মুহুর্মুহু স্লোগানে সেখানে বিচারকাজ চালানোর মতো আর কোনো পরিবেশ বজায় থাকেনি। ময়দানের সমাবেশের মতো হয়ে উঠে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ অন্য বিচারপতিরা চুপচাপ বসে থাকেন। তবে কিছুক্ষণ পরপর প্রধান বিচারপতি কার্যতালিকায় থাকা অন্য মামলার আইনজীবীরা বিচারকাজ শুরু করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু কয়েকশ আইনজীবীর অনবরত স্লোগান, চিৎকার, প্রতিবাদে তা আর সম্ভব হয়নি।
শেষ মুহূর্ত, ১টা ২০ মিনিট :
আদালতকক্ষে স্লোগান চলতে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় বিচারকার্যক্রম। একপর্যায়ে স্লোগান দেখে প্রধান বিচারপতি মুচকি হাসেন। মাঝেমধ্যে অপর বিচারপতি ইমান আলীর সঙ্গে পরামর্শ করতে থাকেন। বিচারপতিদের চোখেমুখে ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অস্বস্তি।
এই অবস্থা চলে দুপুর ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। তখন আপিল বিভাগের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় এজলাস থেকে বের হয়ে খাস কামরায় চলে যান বিচারপতিরা।
এরপর আইনজীবীরাও বিচারকক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন। তারপর আদালত প্রাঙ্গণে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন তাঁর আইনজীবীরা।
মামলার শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এ ধরনের মামলায় জামিন চাইলে আদালত জামিন দিয়ে দেন। এ ধরনের শত শত মামলার নজির রয়েছে।’
অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগে রায়ের আগের দিন দিক-নির্দেশনা দিয়ে দিলে বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এটা খুবই দুঃখজনক।’
গত ২৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যবিষয়ক মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডকে এ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু রিপোর্ট তৈরিতে আরো সময় লাগবে জানিয়ে আজ সময় আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন