মাত্র ছয় মাস বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হারান চোখের দৃষ্টিশক্তি। পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয়-স্বজনদের অবহেলা থাকলেও পাশ থেকে সরে দাঁড়াননি মা-বাবা। তাদের সাহস আর নিজের অদম্য অধ্যবসায়ে সফলতার সাথে এসএসসি ও এইচএসসির গন্ডি পেরিয়ে এখন তিনি স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের ছাত্র। রয়েছে নানা প্রতিভা। প্রতিবন্ধীরা যে থেমে থাকার নয়, তা প্রমাণ করেছেন। লক্ষ্য এখন স্নাতক শেষে যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি, দাঁড়াতে চান বাবা-মায়ের পাশে।
বলছি ঢাকা কলেজের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র মো. রাজীব হোসেনের কথা। ঢাকা কলেজের ইন্টারন্যাশনাল হলের ৩১৮ নং কক্ষে থেকে পড়াশোনা করছেন তিনি। সোমবার (৩ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে জাগো নিউজকে শুনিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প।
জানান, ছয় মাস বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান। এরপর মা-বাবার ভালোবাসা আর নিজের ইচ্ছাতে ভর্তি হন প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিকের পর ভর্তি হন রাজধানীর জান-ই-আলম সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই জিপিএ ৪.৬৯ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকে। জিপিএ ৩.০০ পেয়ে এইচএসসি পাসের পর একই কলেজের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। বর্তমানে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র তিনি।
বেশ সফলতার সাথেই চালিয়ে যাচ্ছেন স্নাতকের পড়াশোনা। সাথে গান-বাজনাতেও বেশ পারদর্শী। ২০০৬ সালে ‘আমরা কুড়ি’ জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় লোকসংগীত (গ) বিভাগে অর্জন করেছিলেন চতুর্থ স্থান। ‘লিও ক্লাব অব ঢাকা রোজ’ থেকে সংগীতে পদক ও বইসহ পেয়েছেন নানা পুরস্কার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়-এর পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে পেয়েছেন ল্যাপটপ। তাছাড়াও কলেজের সাংস্কৃতিক সপ্তাহে অংশ নিয়ে প্রতি বছরই অর্জন করেছেন সনদ ও বিভিন্ন পুরস্কার।
রাজীব জানান, ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি একটু দুর্বলতা ছিল। প্রাথমিকে থাকাকালীন স্কুলে গান শেখানো হলেও পরবর্তীতে আর সেই সুযোগ হননি। তবে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেই চালিয়েছেন চেষ্টা।
লোকসংগীত বেশ পছন্দ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিল্পী মমতাজের সাথে সরাসরি কথা বলার খুব শখ আমার। এক সময় শিল্পী হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও উপযুক্ত পরিবেশ আর চর্চার অভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি। এখন স্বপ্ন স্নাতক শেষ করে শিক্ষাকতা করা।’
গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী বাবা আর গৃহিনী মায়ের তিন ছেলে ও দুই কন্যার মধ্যে রাজীব হোসেনই বড় (ভাইদের মধ্যে)। পরিবারের অভাব অনটনের মধ্যে বাবার দেয়া অর্থেই চলছে তার লেখাপড়া। জানান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধী সনদ পেলেও মেলেনি ভাতা।
আফসোস নিয়ে রাজীব বলেন, ‘বাবা কাপড়ের ব্যবসা থেকে যা আয় করেন সংসারের খরচ কোনোভাবে চালিয়ে আমাদের লেখাপড়ার খরচ যোগান। ইদানিং বাবা খুবই অসুস্থ। আর আমিও কোনো ভাতা পাই না। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে!’
উচ্চশিক্ষা গ্রহণে প্রতিবন্ধীদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীদের ৩০ মিনিট অতিরিক্ত সময় দেয়া হলেও আমাদের ক্ষেত্রে তা দেয়া হয় না। আমাদের মতো যারা স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখা করছে তাদের পরীক্ষার হলে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময় বাড়িয়ে দেয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘তাছাড়া নিচের ক্লাসগুলোতে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করলেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বইগুলোতে আর ওই পদ্ধতি পাওয়া যায় না। এ জন্য পড়ালেখায় অনেকটা অসুবিধা হয়। বই পড়ার জন্য অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব সমস্যার দিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত।’
দেশে প্রতিবন্ধী বেকারত্বের সংখ্যা অনেক বেশি উল্লেখ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রাজীব বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ নিয়োগ দিতে হবে। বেসরকারি চাকরিতে আমাদের সে অনুযায়ী নিয়োগ হয় না। আমরা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি নিয়ে দশজনের মতো বাঁচতে চাই। কারও করুনা চাই না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন