ফেসবুকে নিউজ দেখলাম একজন কাজের বুয়া তার হেফাজতে রাখা বাড়ির মালিকের শিশুটিকে বিরক্ত হয়ে বেদম প্রহার করছে। ভিডিওটি এত অমানবিক যে, দেখার মতো না। পারিবারিক প্রয়োজনে কখনো কখনো স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই কর্মস্থলে থাকতে হয়। ফলে অনেক সময় তাদের সন্তান নিকটাত্মীয় দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির কাছে বড় হয়। যাদের এ সুযোগ বা সৌভাগ্য হয় না তাদেরকে অনেক সময় গৃহকর্মীর ওপর ভরসা করতে হয়।
এ ব্যাপারে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা হলো, আপনি আপনার গৃহকর্মীর সঙ্গে যে আচরণ করবেন আপনার গৃহকর্মী ঠিক সেই আচরণ করবে আপনার সন্তানের সঙ্গে। ব্যতিক্রম আছে, অনেক গৃহকর্মী তার প্রতি আপনার দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন সত্ত্বেও আপনার সন্তানকে সে নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখে আপনার অনুপস্থিতিতে। সেটা আপনার প্রতি তার মহানুভবতা।
আমার অনেক বন্ধুবান্ধব জিজ্ঞেস করেন, 'তাদের সন্তান কাজের ছেলে বা মেয়ের হাতছাড়া অন্য কারো কাছে খায় না এমনকি শোতেও যায় না। এটা কেন?'
এটা এ জন্যে যে সন্তানকে যে ভালোবাসা আদর স্নেহ মমতা দেয়ার কথা ছিল আপনার, সেই আদর ভালোবাসাটুকু আপনার শিশু সন্তান সেই গৃহকর্মীর কাছে পায়। ফলে এমন হয়। এটা ভালো। তবে আপনার ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সময় আপনার শিশু সন্তানের অধিকার জন্মগত। এ থেকে আপনি তাকে কিছুতেই বঞ্চিত করতে পারেন না, না কোন ছুতোয়।
জাপানের শিশু স্কুলের কয়েকটি শিশুকে দেখেছিলাম। জাপানের স্কুলে শিশুদের কী পরিমাণ আদর যত্নে বেড়ে উঠে সেটা আমাদের যে কারো পক্ষেই অকল্পনীয়। আর এর মূল কারণ 'এই শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত'৷
শুধু জাপান নয় উন্নত সব দেশেই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খুবই জোর দেয়া হয়। তাদের কাছে একটা শিশু সুস্থ, সুন্দর দেহ ও মন নিয়ে বেড়ে উঠবে এটাই বেশি প্রাধান্য পায়।
উন্নত দেশে একটা শিশুকে আপনি কখনো বকাঝকা করতে পারবেন না, প্রহার করতে পারবেন না, হোক না সে আপনার শিশু।
আপনার কারণে বা অবহেলায় যদি স্কুলে কখনো আপনার সন্তান মন খারাপ করে বসে থাকে, স্কুল টিচার আদর করে তার মন খারাপ ভালো করে দেবে ঠিকই পাশাপাশি সে কারণটাও বের করার চেষ্টা করবে। দৈবাৎ যদি বেরিয়ে আসে আপনি তাকে বকাঝকা বা মারধোর করেছেন, তবে আর রক্ষা নেই। মুহূর্তেই আপনার বাসায় পুলিশ চলে আসবে। হোক সে আপনার সন্তান কিন্তু তাকে ফিরে পেতে আপনার কঠিন বেগ পেতে হবে। অথবা ফিরে নাও পেতে পারেন।
আমেরিকার নিউইয়র্কে থাকে আমার এক পরিচিত ব্যক্তির কথা বলি। ছোট ছেলেকে ঘরে রেখে তার স্ত্রী পাশেই একটি স্কুলে বড় মেয়েকে পৌঁছে দিতে গিয়েছেন। এদিকে দুষ্টু ছেলে দরজা খুলে ঘর থেকে বাহিরে বেরিয়ে খেলাধুলো শুরু করে দিয়েছে। বিষয়টি টহল পুলিশের নজরে আসে। এর মধ্যে স্কুল থেকে তিনিও চলে আসেন। কিন্তু বিধিবাম, পুলিশ তার ছেলেকে নিয়ে গেছে তাদের হেফাজতে আর দেবে না। তারা সোজা বলেছে, “এ সন্তান তোমার কাছে নিরাপদ না”।
যাহোক অনেক ঝক্কি ঝামেলা শেষে দু’তিন দিন পর সন্তানকে তিনি শর্তসাপেক্ষে ফেরত পান। বন্ধুটির স্ত্রী কেঁদে সেই বিভীষিকাময় কয়েকটি রাতের কথা বললেন আমাদের।
উন্নত বিশ্বে কেনো শিশুদের প্রতি এত যত্ন করা হয়?
আসলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যত্নশীল বলেই তারা আজ বিশ্বে উন্নত। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। এই শিশুই এক সময় তার স্থান থেকে সে দেশের নেতৃত্ব দিবেই। সুতরাং শিশু অবস্থায় সে যদি একটা সুস্থ, সুন্দর মন নিয়ে বেড়ে ওঠে, অবশ্যই পরিণত বয়সে জাতি তার কাছ থেকে একটা সুস্থ সুন্দর কর্ম আশা করা যায়।
এবার আসি গবেষণার কথা বার্তায়। সাইকিয়াট্রিস্টরা গবেষণা করে দেখেছেন, একটা শিশু যদি শিশু অবস্থায় দৈহিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তবে ভবিষ্যতে পরিণত বয়সে সেই শিশু নানা রকম মানসিক রোগে ও জটিলতায় ভুগে। এর মধ্যে রয়েছে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, এনজাইটি, ডিপ্রেশন, সাবস্টেন্স এব্যুজ (মাদকাসক্ত) ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং এ গুলোর ফলে পরিবার সমাজ নানা ভোগান্তি চলে আসে ।
এবার আসি আমাদের দেশে প্রেক্ষাপটে। শিশু নির্যাতন আমাদের দেশে মামুলি বিষয়। স্কুল বা ঘর, প্রায় সব জায়গায়ই কোনো না কোনোভাবে আমাদের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশে এর প্রয়োগ আছে বলে মনে হয় না। গৃহে ছোট ছোট কাজের ছেলে রাখা যেনো একটা ফ্যাশন। সে শিশু গুলো বেশিরভাগই এতিম হতদরিদ্র পরিবারের। আর সেই ছোট ছোট এতিম কাজের ছেলে মেয়েকে চুন থেকে পান খসলেই চড় থাপ্পড়, গায়ে গরম খুন্তির স্যাঁক কেবল অশিক্ষিত নয় অনেক শিক্ষিত উঁচু শ্রেণির পরিবারের মধ্যেও দেখা যায়।
এমনকি যারা শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে কথা বলেন, অনেক সময় দেখা যায় তাদের বাড়িতেই দেখা যায় শিশু নির্যাতনের ভয়ানক দৃশ্য।
এর ফল আমরা ভোগ ও করি। কারন এ শিশু গুলোই আমাদের সমাজে বেড়ে উঠছে নানান মানসিক রোগ নিয়ে। তাদের মাধ্যমেই আমাদের চারপাশে ঘটছে নানা রকমের অপকর্ম অন্যায়। সমাজের বড় বড় অপরাধীর অতীত ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এসব অপরাধী শিশুকালে কোনও না কোনওভাবে মানসিক, দৈহিক, বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
তাই একটু ঘুরিয়ে যদি বলি, আমরাই আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত অপরাধীর জন্ম দেই তাতে খুব একটা মন্দ কথা বলা হবে না।
শেষ করি যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। নিজের হাতে বা অন্যের হাতে, নিজের শিশু বা অন্যের শিশুকে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন কোনভাবেই কাম্য নয়। এ নিয়ে সবার সচেতন হওয়া উচিৎ।
রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি এতিমের প্রতি সদয় নয়, সে মুমিন নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন