অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ পরিচিত নাম, দেশ এবং দেশের বাইরেও।
পরিবহন সংকট ও সমাধান এবং নতুন আইন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সড়ক ও পরিবহন পরিকল্পনার গোড়াতেই ভুল রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। দীর্ঘ আলোচনায় সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ মতামতও ব্যক্ত করেন এ বিশেষজ্ঞ। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
নতুন আইনে নিরীহ মানুষের ওপর যতটা প্রয়োগ করা সহজ হবে, মালিকদের ওপর তত সহজ হবে না
জাগো নিউজ : দিন যাচ্ছে পরিবহন-সড়কের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ভূমি-বাসস্থানের উন্নয়ন হলো কয়েকগুণ। কীভাবে এ সংকট বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে, যদি ব্যাখ্যা করতেন?
সামছুল হক : এখানে বহুপক্ষ জড়িত। ভূমি উন্নয়নের সঙ্গে জড়িতরা, সড়ক অবকাঠামো নির্মাণকারী, বিআরটিএ- কেউই পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে কাজ করেনি। তারা সংকট নিরসনের পরিবর্তে আরও পুঞ্জীভূত করে গেছেন।
জাগো নিউজ : পেশাদারিত্বের প্রশ্নে আসলে কী বুঝব?
সামছুল হক : আজ থেকে ৫০ বছর পর ঢাকার সড়কে কী হতে পারে, সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে পেশাদারিত্ব। সিটিং বাসের ভাড়া নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড চলছে গত ১৫ বছর ধরে। সরকার ভাড়া নির্ধারিত করার পরও সিটিং বাসগুলো অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া শুরু করল। শুরুতে কিছুই করল না। অথচ, তখন ব্যবস্থা নেয়া সহজ ছিল। এখন সবাই দরজা খোলা রাখে। সরকার আর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
সরকারকে সত্যের কাছাকাছি আসতে হবে। ফিটনেস, লাইসেন্সের শর্ত কী, আর দিচ্ছি কীভাবে, তার জবাব পেতে হবে
পেশাদারি সংগঠন হলে শুরুতেই সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবে এবং তার আলোকে ব্যবস্থা নেবে। তা করেনি। ১৫ বছর ধরে এমন একটি তুঘলকি কাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে বাসগুলো ব্যবসা করছে। জনদুর্ভোগের জায়গা থেকে গত বছর মানুষ যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল, তখন বিআরটিএ অভিযান পরিচালনা করল। অভিযানের কারণে বাসগুলো সড়ক থেকে সরে গেল। জনদুর্ভোগ আরও বাড়ল।
গণতান্ত্রিক সরকার যেকোনো জনদুর্ভোগকে ভয় পায়। অভিযান থেকে সরে এলো। তার মানে, পরিকল্পনা জন্মের সময় নজর দেয়া হয়নি। ঢাকা শহরে ট্রাক টার্মিনাল না থাকলে কী হতে পারে, তা পেশাদার প্রতিষ্ঠানের জানা থাকার কথা। তা না জেনে হঠাৎ করে পুলিশকে দিয়ে ট্রাকচালককে বলা হচ্ছে, তোমাকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেব না।
চালক বলছে, তাহলে আমি কোথায় দাঁড়াব? আপনি নগর পরিকল্পনা করলেন, যানবাহনের অনুমোদন দিলেন, অথচ দাঁড়ানোর কোনো জায়গা দিচ্ছেন না, তা তো হতে পারে না।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, হয় নিজের স্বার্থে অথবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্বার্থে কাজগুলো করা হচ্ছে। রাজউক ভূমি উন্নয়ন করছে। কিন্তু একটি ট্রাক টার্মিনালের উন্নয়ন করতে পারল না? আসলে ভূমি উন্নয়ন করে নিজেরা নিজেরা-ই লাভবান হচ্ছেন।
আমার কাছে মনে হয়, সরকার পরিবহন খাতে হস্তক্ষেপ করতে চায় না
এরশাদ সরকারের পর আর কোনো সড়ক হবে না, তা বিশ্বাস করা যায় না। আমার শরীর অপরিকল্পিতভাবে প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু মেরুদণ্ড সরুই থাকছে। আমি তো কুঁজো হব-ই।
জাগো নিউজ : এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা প্রতিদিন শতশত নতুন গাড়ি নামতে দেখছি এবং তা চাহিদার ভিত্তিতেই…
সামছুল হক : পেশাদার সংগঠনগুলোর মারাত্মক ভুলের কারণেই গোটা দেশ এখন কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। ভুল হচ্ছে এখনও।
বিআরটিএ অনুমোদন দেয়, নিবন্ধন করে এবং চালক তৈরি করে। একজন ভারি গাড়ির মালিক যদি বিআরটিএ-কে বলে, চালক নেই তো আপনি আমাকে গাড়ি কেনার অনুমোদন দিলেন কেন? আপনি জানেন চালক নেই, তবুও নিবন্ধন দিলেন! তার মানে, আমি অবৈধ চালক দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম এতদিন।
চালকের সংখ্যাগত ঘাটতি রেখে কেন আমাকে গাড়ি নামানোর অনুমোদন দিলেন? আপনি এখন আমার ওপর জুলুম করছেন। আমি তো আদালতে যাব-ই
চালকের সংখ্যাগত ঘাটতি রেখে কেন আমাকে গাড়ি নামানোর অনুমোদন দিলেন? আপনি এখন আমার ওপর জুলুম করছেন। আমি তো আদালতে যাব-ই।
এখনও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এটি কোনো পেশাদারি সংগঠনের পরিচয় হতে পারে না। অনুমোদন না দিলে সমস্যা এক প্রকার। কিন্তু অনুমোদন দিয়ে বহু প্রকার সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ : তার মানে, মালিকরা বেকায়দায় পড়েই আন্দোলন করছেন?
সামছুল হক : কাভার্ড ভ্যানমালিকরা নতুন আইনের বিরোধিতা করে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। বিআরটিএ’র তালিকায় কাভার্ড ভ্যান নামে কোনো গাড়ির অস্তিত্ব নেই। এটি একটি রূপান্তরিত পরিবহন। গত ১৫ বছর ধরে প্রায় ২২ হাজার কাভার্ড ভ্যান তৈরি করা হয়েছে, অথচ বিআরটিএ কোনো ব্যবস্থাই নিল না।
আমার শরীর অপরিকল্পিতভাবে প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু মেরুদণ্ড সরুই থাকছে। আমি তো কুঁজো হব-ই
এখন যদি হঠাৎ করে বলে যে, কাভার্ড ভ্যানের অনুমোদনই নেই। তাহলে মালিকদের তো দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়া হলো। মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে এ প্রতিষ্ঠানগুলো এতই সরলীকরণ করে ফেলছে যে, এখন আর উপায় বের করতে পারছে না। সমস্যাগুলো এতই জটিল করেছে যে, পরিবহনের যেখানে হাত দেবে সেখানেই কাদা। বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম পরিবহন খাত।
জাগো নিউজ : সরকার কিন্তু নানা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রেখেছে…
সামছুল হক : এটি একটি ভালো দিক যে, সরকার সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা তৈরি করেছে। ক্ষমতার ধারাবাহিকতা থাকার কারণেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। অথচ, দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, পরিবহন খাতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দৃঢ়তার সঙ্গে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।
জাগো নিউজ : এর কী কারণ থাকতে পারে?
সামছুল হক : আমার কাছে মনে হয়, সরকার পরিবহন খাতে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। আমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের বলেছি, পরিবহনে ব্যবস্থা নিলে নির্বাচনের পরপরই নিতে হবে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নিতে গেলে অপরিপক্কতার পরিচয় দেয়া হবে।
পরিবহন খাতের কোথায় কোথায় সমস্যা এবং সমাধান করতে গেলে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে, তার সবই আপনাদের জানা। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে কিন্তু আর সময় নেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সবকিছু জানার পরও সময় পার করে ফেললেন।
জাগো নিউজ : যুদ্ধাপরাধ বিচারের মতো সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারল। অথচ, পরিবহন খাত...
সামছুল হক : এ প্রশ্ন আমারও। সরকারের অর্জন কম নয়। অথচ পরিবহন খাতের নৈরাজ্য সরকার সামাল দিতে পারছে না।
জাগো নিউজ : এটি সরকারের ব্যর্থতা নাকি অসহায়ত্বের প্রকাশ?
সামছুল হক : আমি মনে করি, সরকারের বিশেষ কৌশলী অবস্থান এখানে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঘিরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনে পরিবহন মালিক ও চালকরা ব্যাপক সহায়তা করেছে সরকারকে। তাদের সেই অবদানকে সরকার ভুলে যায়নি। যদিও তাদের বেশির ভাগই সরকারপক্ষের লোক।
জাগো নিউজ : তার মানে বিশেষ প্রতিদান দিতে মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে?
সামছুল হক : সরকার পরিবহন মালিক-চালকদের প্রতিদান অন্যভাবেও দিতে পারে। কিন্তু আমজনতাকে একেবারে জিম্মি করে পরিবহন খাতকে নজরের বাইরে রাখা কোনো শুভ সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
মানুষ জিম্মির পাশাপাশি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে পরিবহন। দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে কেউ ঢাকায় এলে যানজটে আটকে যেতে হচ্ছে। সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের মতো আমাদের নগরীর মান একেবারে তলানীতে। আমি বুঝতে পারি না, সরকার কীভাবে এ পরিস্থিতি মেনে নেয়!
ধারাবাহিক সরকারের প্রথমবার বুঝতে বুঝতেই সময় চলে যায়। দ্বিতীয়বার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা শুরু করে। তৃতীয়বার ফলাফল পেতে থাকে। অথচ, এ সরকার তৃতীয়বারে এসেও বুঝতে পারছে না যে, পরিবহন সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে?
গুলশানে আগে ১১টি কোম্পানির বাস চলত। মেয়র আনিসুল হক পরিবর্তন আনলেন। এখন একটি অপারেটর পরিচালনা করছে। হাতিরঝিলের উদাহরণ আছে। পাইলোটিং হয়েছে। এখন গোটা ঢাকা শহরে করবে এবং তা সরকারের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। কোথায় যেন সরকার আটকে যাচ্ছে!
জাগো নিউজ : পরিবহন মালিকদের প্রতিদান দিতে গিয়ে সরকার মানুষের জন্য আর কী বিপদ আনছে?
সামছুল হক : বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। সরকারের জন্যও বিপদ। স্ট্যাডি করে ২০১৩ সালে সমাধানের পথ বের করা হয়েছে। ১৫৬টি রুটকে ২২টি রুটে এনে পাঁচটি অপারেটর দিয়ে চালানোর কথা বলা আছে।
রুট কমানোর পরিবর্তে এখন ৩৩০টি রুট করা হয়েছে। কীভাবে জট পাকানো যায় তারই আয়োজন করছেন সংশ্লিষ্টরা। তার মানে, পরিবহন সেক্টর সরকারের হাতে নেই। জনস্বার্থে নয়, সরকার মালিকদের স্বার্থে ছাড় দিতে দিতে নিজেরও অস্বস্তির কারণ বানিয়েছে পরিবহনকে। বলা যায়, জোড়াতালির সমাধান এবং পেশাদারিত্ব জ্ঞানের পরিধি না বাড়ানোর কারণে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর করা হয়েছে। রোগ জটিল হলে টাকা থাকার পরও রোগীকে বাঁচানো যায় না। জোড়াতালি দিয়ে দিয়ে ঢাকার অবস্থা তা-ই করা হয়েছে।
সড়ক থেকে রিকশা তোলা সম্ভব নয়। ৩৩০টি বাস রুটকে পাঁচটিতে আনা সম্ভব নয়। বিনিয়োগকারীরা আসতে চাইবেন না। যাকে ইচ্ছা তাকেই সিএনজি অটোরিকশার অনুমোদন দেয়া হলো। প্রাইভেট সিএনজিও দেয়া হলো। তারা মিটারে চলে না। হাজার হাজার প্রাইভেট কারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কোনটা রেখে কোনটায় সমাধান টানবেন?
আইন তৈরি করার নেপথ্যের কারণ হচ্ছে যানজট দূর এবং নিরাপদ সড়ক তৈরি করা। আইন দিয়ে আমি শাসন করতে পারি। কিন্তু বিআরটিএ দেখবে কে? একজন ইন্সপেক্টর দিয়ে একটি গাড়ির ৬২টি আইটেম চেক করার কথা। দেড় ঘণ্টা লাগবে। কোন গাড়িটি দেড় ঘণ্টা চেক করা হয়েছে? দেখাতে পারবেন না। সেই জনবলই নেই। একজন দিনে ১০০ গাড়ি চেক করেন।
আপনি এখানে ঘাটতি রেখে সড়ক নিরাপদ চাইতে পারেন না। এক মিনিটেই ছাড়পত্র দেয়া হয় গাড়ি চোখে দেখে। আবার অনেক সময় গাড়ি বিআরটিএ-তে আনাও হয় না। বিশেষ সুবিধায় বিশেষ ছাড়পত্রের ব্যবস্থা! এগুলো তামাশা ছাড়া আর কিছুই না। ঠিকমতো চেক করলে ঢাকায় চলার মতো একটি গাড়িও পাওয়া যাবে না। তার মানে, সরকারকে টাকা দিয়ে আমি ফিটনেস পেয়ে গেলাম। মাঝখানে অন্যরা হিসেব মিলিয়ে নিল।
এরপর চালকের বিষয় আসে। শারীরিক, মানসিক ও জ্ঞানগত পরীক্ষা না করেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই আমি বলি, সরকারকে সত্যের কাছাকাছি আসতে হবে। ফিটনেস, লাইসেন্সের শর্ত কী, আর দিচ্ছি কীভাবে, তার জবাব পেতে হবে।
জাগো নিউজ : তাহলে নতুন আইনের ফলাফল কী?
সামছুল হক : নতুন আইনে নিরীহ মানুষের ওপর যতটা প্রয়োগ করা সহজ হবে, মালিকদের ওপর তত সহজ হবে না। পথচারী, অবৈধ পার্কিংয়ের দায়ে জরিমানা গুণবেন। প্রভাবশালী মহল ছাড় পেয়ে যাবেন। সুতরাং অবকাঠামোগত পরিবর্তন না করে শুধু আইনের ওপর নির্ভর করে সড়ক নিরাপদ করে তুলতে পারবেন না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন