জামালপুর‘পানি আনতে শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ঘর থেকে বের হই। ঘরের পেছনে লুকিয়ে থাকা রফিজ উদ্দিন (৩৮), ছানোয়ার (৩৪) ও শাওন (২৫) আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। ছানোয়ারের বাড়ির পেছনে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং অনেক মারধর করে। পরে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে আরও নির্যাতন করে। এ খবর শুনে ওই তিন পাষণ্ডের হাত থেকে বাঁচাতে আমার স্বামী দৌড়ে আসে। আমাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু তারা আমার স্বামীকে মারধর করে ওখান থেকে নিয়ে যায়। একটু পরে ফিরে এসে ওরা বলে, তোর স্বামী আত্মহত্যা করেছে। আমার স্বামী কেন আত্মহত্যা করবে? আমার স্বামীকে ওরা খুন করেছে। মেরে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমি অনেক কান্নাকাটি করেছি আমার স্বামীকে দেখার জন্যে। এরা দেখতে পর্যন্ত দেয়নি। সারারাত গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করেছে। শনিবার সকালে পুলিশ এসেছে এমন খবরে তারা আমার বাঁধন খুলে দিয়ে ছানোয়ারের বাড়ির একটি রুমে নিয়ে বন্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে। আমার স্বামীর লাশ নিয়ে যায়। পুলিশকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের কথা বলেছি। আমার স্বামীকে খুনের কথা বলেছি। কিন্তু পুলিশ আমার স্বামীর লাশের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যায়। আমার কোনও অভিযোগ তারা নেয়নি। পুলিশের এসআই মো. গোলজার আলম আমার স্বামীকে হত্যা এবং আমাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ কোনও গুরুত্বই দেননি।’
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই নারী কাঁদতে কাঁদতে বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন। জামালপুর সদর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর এলাকায় গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) রাতে ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। ভিকটিম জানান, রফিজ উদ্দিন (৩৮), ছানোয়ার (৩৪) ও শাওন (২৫) দীর্ঘদিন ধরে তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। তিনি তাদের কথায় আমল না দেওয়ায় এবং তার স্বামী-শ্বশুরের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ভিকটিম অভিযোগ করেন, ধর্ষণকারীরা তার স্বামীকে নির্যাতন করে হত্যার পর তাকে গাছে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এই গৃহবধূ কান্নারত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি পুলিশকে আমাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের কথা বলেছি। আমার স্বামীর এমন মৃত্যুতে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। পুলিশ আমার স্বামীর লাশের সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যায়। তবে আমার কোনও অভিযোগ তারা নেয়নি। আমার স্বামীকে হত্যা এবং আমাকে ধর্ষণের অভিযোগে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাকে তারা ছেড়ে দেয়। পরে আমি বাধ্য হয়ে বিচারের আশায় প্রেস ক্লাবে আসি। আমি আমার স্বামী হত্যার এবং আমাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিচার চাই।’
জামালপুর প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকরা সোমবার রাতে গুরুতর অসুস্থ ওই গৃহবধূর ঘটনা শোনেন এবং তাকে রাত ১০টার দিকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। ওই গৃহবধূ প্রসূতি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। পরে সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে সোমবার রাত ১১টার দিকে ছানোয়ার, রফিজ ও শাওনের নাম উল্লেখসহ আরও দুইজনকে অজ্ঞাত আসামি করে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের একটি মামলা হয়। রাতেই অভিযান চালিয়ে আসামি শাওনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে ছানোয়ার ও রফিজ পলাতক রয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘরেও কেউ নেই।
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হাসানুল বারী শিশির জানান, ‘ওই গৃহবধূর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামতও পাওয়া গেছে। তবে ডাক্তারি পরীক্ষার পরে ধর্ষণের বিষয়ে আরও পরিষ্কার হওয়া যাবে। তাকে হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
ভিকটিমের শ্বশুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে মারা গেছে। তবে সে মারা গেছে না আত্মহত্যা করেছে সেটা আমি জানি না।’
শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুল হক বলেন, ‘ওই নারী প্রথমে ঘটনাটি আমাকে জানায়নি। পরে বিষয়টি জানতে পেরে আমি পুলিশে খবর দেই। নির্যাতনকারীরা দিনমজুর শ্রেণির। তারা কোনও প্রভাবশালীর সহায়তা পাবে না। নির্যাতনকরীদের আইনের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে আমি অবশ্যই ভিকটিমের পরিবারকে সহায়তা করবো।’
তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এসআই মো. গোলজার আলমকে পাওয়া যায়নি। তবে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালেমুজ্জামান বলেন, ‘আমরা শ্রীপুরের রামকৃষ্ণপুর এলাকার এক ব্যক্তির আত্মহত্যার খবর পাই। পরে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ওই ব্যক্তির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে। সেটা আত্মহত্যা না হত্যা তা জানার জন্য লাশটির ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে সেটা জানা যাবে। তবে ওই গৃহবধূকে ধর্ষণের বিষয়ে প্রথমে আমার কাছে কেউ কোনও অভিযোগ দেননি। তিনি আমার কাছেও আসেননি। গৃহবধূ ধর্ষণের বিষয়টি আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারি। পরে থানায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলা নেওয়া হয়েছে। এক আসামিকে গ্রেফাতারও করা হয়েছে। পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ সঠিক নয়। অন্য আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওই মহিলা ধর্ষণের বিষয়ে আমাদের কাউকে কিছু বলেননি বা কোনও অভিযোগ দেননি। আমাদের না জানালে আমরা জানবো কীভাবে? তিনি আমাদের কাছেও আসেননি। গৃহবধূ ধর্ষণের বিষয়টি গতকাল সোমবার আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারি। পরে থানায় ওসি সাহেবকে বলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলা রেকর্ড করার কথা বলি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন