ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা)-এর মতো দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দুর্দান্ত প্রতাপে মহাপরিচালক পদ দখল করে আছেন। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে অঢেল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে, গত ১০ বছরে ইফায় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা হোরিলুট করেছেন তিনি। সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ২৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে যার সবগুলো অনিয়মের সাথেই ইফা ডিজির সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
ডিজি দুর্নীতিতে ধরা খাচ্ছেন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তড়িঘড়ি মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের ফান্ড থেকে প্রথম দফায় গত ২৩ অক্টোবর সোনালী ব্যাংক পাবলিক সার্ভিস কমিশন শাখায় একটি চেকের মাধ্যমে প্রায় ৩২ কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় গত ৩১ অক্টোবর সোনালী ব্যাংকের একই শাখায় ৩টি চেকের মাধ্যমে ৪২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। যার ফলে দেশ ফিরে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া সোয়া ৭৩ কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে দৈনিক-ভিত্তিতে শত শত কর্মচারী নিয়োগ, অন্যের দ্বারা বই লিখিয়ে লাখ লাখ টাকার রয়্যালিটি গ্রহণ, বিনা কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রত্যাহারসহ নানা অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে বাসায় ইফার একটি গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ও রয়েছে। যে সামীম আফজালের একটু অনুগ্রহ পেতে ইফার সবাই মুখিয়ে থাকতেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ তার পাশে নেই। খোদ ইফার কর্মকর্তারাই এখন ফাঁস করছেন মহাপরিচালকের নজিরবিহীন দুর্নীতির অজানা নানা তথ্য। এমনকি চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়কদের সঙ্গে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকায় তার নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
ইফার ডিজি বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেননি, নিরীক্ষার পর এখন বাধ্য হয়ে ফেরত দিলেন। এতো দিন কেন তিনি দিলেন না! তার সাথে আর কে কে জড়িত এই হরিলুটে, এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। একথা প্রমাণিত যে তিনি দুর্নীতিতে ধরা খেয়ে নিজেকে সাধু প্রমাণ দিতে ৭৩ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন। সরকারের আরো কয়েক শত কোটি টাকা রয়েছে তার কব্জায় সেই হিসাব এখনো অজানা। কিন্তু ৭৩ কোটি টাকা ফেরত দিলেও সেই টাকার সুদ ফেরত দেননি। রাষ্ট্রের ৯০০ কোটি টাকা নয়-ছয় করল এই দুর্নীতিবাজ, তারপরও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি এমনকি মহাপরিচালকের পদ থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়নি।
ইসলামী লেবাসে ইফার ডিজি দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করলো সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এতো দিন কেন নিরব ছিলো, কেন ইফায় গত ১০ বছর নিরীক্ষা করা হয়নি? দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কি করছিল এতো দিন? ইফার ডিজির দুর্নীতি নিয়ে কয়েকশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী লাগাতার আন্দোলন করলেন তারপরও কেন দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চালানো হয়নি। আসলে দুদকের কাজটি কি- এসব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
যে সব খাতে অনিয়ম ও সরকারের অর্থের ক্ষতি
গত ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরের শেষদিনে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে ৬৪ জেলায় অর্থ ছাড় করা হয় ৩১ কোটি ৯৯ লাখ ১৫ হাজার ২২০ টাকা; যা অনিয়ম। আর্থিক বছর শেষে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে না দেয়ায় ক্ষতি ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার ৫৭৩ টাকা। গণশিক্ষা কেন্দ্রের জন্য পাঠ্যবই মুদ্রণে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ২০ কোটি ৯৮ লাখ ১৬ হাজার ৪৮৭ টাকা এবং কোরআনুল কারিম মুদ্রণে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে অতিরিক্ত মূল্যে কার্যাদেশ দেয়ায় ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ৪১৭ টাকা ক্ষতি হয়েছে। কার্যাদেশের পরিমাণের চেয়ে কম কোরআন শরিফ নেয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৩২ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা। বোগদাদিয়া কায়দায় ক্ষতি এক কোটি টাকা। জিওবির বরাদ্দের অব্যয়িত টাকা জমা না দেয়ায় ২২ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার ৫০৯ টাকা ও সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন ছাড়াই বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানকে ১৬ কোটি ৩০ লাখ ১০০ টাকা দেয়া হয়। অব্যয়িত পুঞ্জীভূত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়ায় ক্ষতি ৯৯ কোটি এক লাখ ৬ হাজার ৭৪৪ টাকা। প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা ইফার স্থায়ী ফান্ডে আমানত করায় সরকারের ক্ষতি ৪৬ কোটি ৩৩ লাখ ৭ হাজার ৫৬৩ টাকা, বিধিবহির্ভূত ৪৭ জনকে প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগ দেয়ায় ক্ষতি ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬০ টাকা। একইভাবে আরও ১৬৭ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়ায় ক্ষতি প্রায় ৮ কোটি টাকা। দৈনিকভিত্তিক কর্মচারীদের রাজস্ব পদে স্কেলভিত্তিক নিয়োগ দেয়ায় ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ হাজার ৯৯৮ টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং দারুল আরকাম মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বরাদ্দের টাকা রেখে দেয়ায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। এই সব তথ্য উঠে এসেছে সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ।
প্রেসের মেশিন ক্রয়ে সোয়া কোটি টাকা লোপাট
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রেস দেশের প্রথম শ্রেণির ছাপাখানাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখান থেকে লাখ লাখ পবিত্র কুরআনুল করীম ছাপানো হয়। কিন্তু ডিজিটাল প্রেসের মেশিন ক্রয়ের নামে ২০১০ সালে এক কোটি ৭৯ লাখ ৮৮ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করা হলেও মাত্র ৪৫ লাখ টাকায় মেশিন কেনা হয়। এক্ষেত্রে প্রায় সোয়া কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ফাইলে দেখানো হয়েছে হাইডেলবার্গ, জার্মানির মেশিন। কিন্তু বাস্তবে কেনা হয়েছে চায়না মেশিন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছাপাখানার উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর প্রেস থেকে অবৈধভাবে ৭০ লাখ টাকার কুরআনুল করীম ছাপানো হয়। এছাড়া বাইরের প্রেস থেকে প্রয়োজনীয় পুস্তকাদি ছাপানো বাবদ ৩৬ কোটি ৫৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৬ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণার অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়নি এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সিডি ভ্যাটের অব্যয়িত দেড় কোটি টাকাও জমা দেয়া হয়নি। বায়তুল মোকাররমের দোকান ভাড়ার ২ কোটি ৬১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা অনাদায়ী রয়েছে।
অন্যকে দিয়ে বই লিখিয়ে লাখ লাখ টাকা রয়্যালিটি গ্রহণ
মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের আগে সামীম মোহাম্মদ আফজালের নিজ নামে কোনো বই ছিল না। কিন্তু ইফার ডিজির দায়িত্ব নেয়ার পর তার নামে ২৫টির অধিক বই বের হয়। অভিযোগ রয়েছে, একটি বইও তিনি নিজে লেখেননি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও নুরুল ইসলাম মানিক অধিকাংশ বই লিখে দিয়েছেন। অন্যের লেখা বই ডিজি নিজের নামে ছাপিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে লাখ লাখ টাকার রয়্যালিটি গ্রহণ করেছেন।
ডিজির পীরকে অবৈধভাবে ১৪ লাখ টাকা প্রদান
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল নারিন্দার মশুরীখোলা দরবারের পীর শাহ মোহাম্মদ আহছানুজ্জামানের মুরিদ। বোগদাদী কায়দা নামে একটি আমপারা শাহ মোহাম্মদ আহসানুজ্জামানের নামে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ থেকে ছাপা হয়। ওই বইয়ের রয়্যালিটি বাবদ তাকে ১৪ লাখ টাকা প্রদান করা হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। কারণ বোগদাদী কায়দা সুপ্রাচীন কাল থেকে এ উপমহাদেশে কুরআন শরীফ শেখার জন্য পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এটার লেখক শাহ আহসানুজ্জামান নন। অথচ ডিজি তার পীর শাহ আহছানুজ্জামানের নামে লাখ লাখ বোগদাদী কায়দা ছেপে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণ
ডিজি হিসেবে যোগদানের পূর্বে তার ভায়েরা-ভাই সৈয়দ শাহ এমরান এখানে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, এছাড়া গত ১০ বছরে ডিজি তার অসংখ্য আত্মীয়-স্বজনকে অন্যায়, অনিয়ম ও অবৈধভাবে এখানে চাকরি দিয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন- সহকারী পরিচালক পদে ডিজির আপন বোনের মেয়ে ফাহমিদা বেগম (বর্তমানে কক্সাজারের উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত), মহিলা কো-অর্ডিনেটর অফিসার পদে আরেক বোনের মেয়ে সিরাজুম মুনীরা (বর্তমানে দ্বীনী দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগের মহিলা শাখায় কর্মরত), সহকারী পরিচালক পদে আপন ভাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি), বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম পদে আপন বোনের ছেলে মাওলানা এহসানুল হক, উৎপাদন ব্যবস্থাপক পদে ভাইয়ের ছেলে মো. শাহ আলম (বর্তমানে চট্টগ্রামে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত), প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে আরেক ভাইয়ের ছেলে মো. রেজোয়ানুল হক (বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাপাখানায় উৎপাদন ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত), হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে আরেক ভাইয়ের ছেলে মো. মিসবাহ উদ্দিন (৫৬০ মডেল মসজিদ প্রকল্পে কর্মরত), আর্টিস্ট পদে শ্যালিকা ফারজিমা মিজান শরমীন (বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাপাখানায় কর্মরত), সহকারী পরিচালক পদে ভায়রার ছেলে মো. মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে প্রশাসন বিভাগে কর্মরত), সহকারী পরিচালক পদে বন্ধুর মেয়ে সৈয়দ সাবিহা ইসলাম (বর্তমানে প্রশাসন বিভাগে কর্মরত), সহকারী পরিচালক পদে আরেক আত্মীয় আবদুল্লাহ আল মামুন (বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাপাখানায় উৎপাদন ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত), সহকারী পরিচালক পদে আরেক আত্মীয় ইলিয়াস পারভেজ (মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পে কর্মরত), ডিজির ছেলে অনিকের গৃহশিক্ষক আতিয়ার রহমানকে প্রোগ্রাম অফিসার পদে (ইসলামিক মিশন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত) নিয়োগ প্রদান করেন। এগুলো সবই প্রথম শ্রেণির পদ।
এছাড়া ভাইয়ের ছেলে মো. রাসেল মিয়াকে ইসলামিক মিশনের ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান পদে, আপন ভাইয়ের ছেলে মুনিমকে এলডিএ পদে, মাহমুদকে এলডিএ পদে, মাহমুদের স্ত্রীকে ল্যাব-টেক পদে, রতনকে ফিল্ড সুপারভাইজার পদে, ফয়সালকে হিসাবরক্ষক পদে, আনোয়ারুল আজিমকে উচ্চমান সহকারী এবং আনোয়ারুল হককে গবেষণা সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব নিয়োগে কোনো নিয়মনীতি কিংবা মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়নি। এছাড়া ডিজির ঘনিষ্ঠ পরিচালক মু. হারুনুর রশিদের (ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা) ছেলে নাজমুস সাকিবকে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে (বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় সহকারী পরিচালক পদে), ডিজির ঘনিষ্ঠ পরিচালক তাহের হোসেনের স্ত্রীর বোনের মেয়ে সাহিনা আক্তারকে সহকারী পরিচালক পদে (বর্তমানে ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে কর্মরত), পীরভাই জালাল আহমদের স্ত্রী মাহমুদা বেগমকে প্রোগ্রাম অফিসার পদে (কেন্দ্রীয় অর্থ ও হিসাব বিভাগে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত), ডিজির ঘনিষ্ঠ পরিচালক এ বি এম শফিকুল ইসলামের আত্মীয় হোমায়রা আক্তারকে পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে (পরিকল্পনা বিভাগে কর্মরত) নিয়োগ দেন। আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের নিয়োগ দিতে তিনি কোনো বিধি-বিধানের ধার ধারেননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম জালিয়াতিরও আশ্রয় নেন। যেমন- আর্টিস্ট পদে কর্মরত ডিজির শ্যালিকা ফারজিমা মিজান শরমিনের চাকরির আবেদনেরই কোনো যোগ্যতা ছিল না। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে কর্মরত ডিজির ভাতিজা মো. মিসবাহ উদ্দিনের জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, অথচ তাকে ঢাকা জেলার কোটায় চাকরি দেয়া হয়েছে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম পদে কর্মরত ডিজির ভাগ্নে মাওলানা এহসানুল হকের চাকরি লাভের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নেই। এ বিষয়ে হাইকোর্টেও মামলা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ছাপাখানায় উৎপাদন ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ডিজির ভাতিজা মো. রেজোয়ানুল হককে প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওই পদে যোগ্যপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাসির উদ্দিন শেখকে বাদ দিয়ে নম্বর বাড়িয়ে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
নিয়ম বহির্ভূতভাবে দৈনিক-ভিত্তিতে ৬/৭শ কর্মচারী নিয়োগ
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে দৈনিক-ভিত্তিতে ৬০০-৭০০ জন কর্মচারী নিয়োগ দেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল। আর্থিক লেনদেন, স্বজনপ্রীতি, পদ রক্ষা, আত্মীয়করণ ইত্যাদির জন্য তিনি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দৈনিক-ভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তাদের নিয়মিতকরণ করা হয়। যদিও দৈনিক-ভিত্তিতে চাকরি দেয়ার কোনো বিধি-বিধান নেই।
ইমামদের সামনে ব্যালে নৃত্য প্রদর্শন
২০১০ সালে এক অনুষ্ঠানে ব্যালে নৃত্য প্রদর্শন করে ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল ইসলাম ধর্মের অপমান করেন। এর বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তার পদত্যাগও দাবি করা হয়। ওই সময়ে কৌশলে তিনি রক্ষা পান।
বিনা কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাসপেন্ড
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি দায়িত্ব গ্রহণের পর কোনো কারণ ছাড়াই বহু সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাসপেন্ড করা হয়। সর্বশেষ তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ ও মার্কেট বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ মহীউদ্দিন মজুমদারকে গত ৩ জুন কোনো কারণ ছাড়াই সাসপেন্ড করেন। ফাউন্ডেশনের পরিচালক মো. আফজাল উদ্দিন ও পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ারসহ অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সামান্য অজুহাতে সাসপেন্ড করা হয়। ফলে ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে।
১০ পদে নিয়োগে মহাজালিয়াতি!
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০টি পদে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। ওই নিয়োগে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। জানা যায়, ২০১০ সালের ২৫ অক্টোবর নিয়োগ ও পদোন্নতি সংক্রান্ত সিলেকশন কমিটির একটা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং যথারীতি কার্যবিবরণী প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পরতে পরতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি থাকায় নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সচিব ড. আলফাজ হোসেন রেজুলেশনে সই করেননি। দুর্নীতিবাজরা এ নিয়ে মহা বিপাকে পড়ে যান। পরবর্তীতে ড. আলফাজ হোসেনকে ছুটি দেখিয়ে তার লিভ-সাবস্টিটিউট হিসেবে ফাউন্ডেশনের প্রভাবশালী পরিচালক তাহের হোসেনকে সচিবের দায়িত্ব দিয়ে ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর সিলেকশন কমিটির আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায়ও একটি রেজুলেশন হয়। সেখানে দেখা যায় যে, একটি নিয়োগের বিপরীতে দুটি রেজুলেশন গৃহীত হয়। যা মহাজালিয়াতি, অনিয়ম ও অন্যায় বলে মন্তব্য করেন ইফার একাধিক কর্মকর্তা। ওই দুটি রেজুলেশন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাওয়া মো. রেযোয়ানুল আলম ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভার রেজুলেশনে মৌখিক পরীক্ষায় ১২ পান কিন্তু ২৬ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সভার রেজুলেশনের মৌখিক পরীক্ষায় ১৬ নম্বর দেখানো হয়। আর্টিস্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ফারজীমা মিজান শরমীন প্রথম রেজুলেশনে মৌখিক পরীক্ষায় ১৫ পান কিন্তু পরের সভার রেজুলেশনের মৌখিক পরীক্ষায় ১৭ নম্বর দেখানো হয়। একইভাবে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মো. নাজমুস সাকিবকে আগে ও পরের সভার রেজুলেশনে মৌখিক পরীক্ষায় ১৮ ও ১১ নম্বর দেখানো হয়। এভাবে দুটি রেজুলেশনে প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরে ব্যাপক গরমিল দেখা যায়। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের নেয়ার জন্য মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রয়োজন মোতাবেক কম-বেশি করা হয়। এ নিয়োগে সবচেয়ে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্যপ্রার্থী থাকার পরও এ কোটা থেকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এমন এক চাকরিপ্রার্থী নাসির উদ্দিন শেখ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে তার নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে ডিজির ভাতিজা রেজোয়ানুল হককে নিয়োগ দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, ইফা’র ডিজির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সামীম মোহাম্মদ আফজাল সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে- এমন কথা বলে প্রভাব খাটাতেন। ধর্মের লেবাস পরা এই দুর্নীতিবাজকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কমুক্ত উচিত সরকারের।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১১ নভেম্বর ২০১৯ প্রকাশিত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন