সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসিসহ কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা ও সরকারি চাকরিবিধির তোয়াক্কা না করে এডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে এবং ৩০ বছরের বেশি বয়সে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
প্রথমে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে পরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাদেরকেই অভ্যন্তরীণ প্রার্থী হিসেবে যোগ্যতা শিথিল করে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়। এসব অনিয়মে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে ৭শ’ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গেও প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এছাড়া কোটা পদ্ধতি না থাকলেও কোটায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এবং ১২ ফেব্রুয়ারি অস্থায়ী ভিত্তিতে ৬ মাসের জন্য ১০ জনের বেশি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগ দেন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. এম গোলাম শাহী আলম। যদিও শোনা যায়, পুরো নিয়োগেই কলকাঠি নাড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর দুই কর্মকর্তা।
তাছাড়া সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স ৩০ বছরের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু এসব নিয়োগের মধ্যে হেলথ কেয়ার সেন্টারে সেকশন অফিসার (গ্রেড-১) পদে নিয়োগ পান রথীন্দ্র মল্লিক, যার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর।
২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগপত্র পাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৩৩ বছর ৩ মাস ১৩ দিন। অন্যদিকে ৯ ফেব্রুয়ারি প্রক্টর কার্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পাওয়া কামরুল ইসলামের জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৮৭ সালের ২ জানুয়ারি। নিয়োগ প্রাপ্তির দিন তার বয়স ছিল ৩০ বছর ১ মাস ৭ দিন।
ওই সময় নিয়োগ বাণিজ্যের নানা অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুখরিত ছিল। স্থানীয় এক বিএনপি নেতার মেয়ে তাহমিনা আক্তার চৌধুরীকে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন একই ভিসি। সে সময় ৭ লাখ টাকায় এ নিয়োগ দেয়া হয়েছিল বলেও গুঞ্জন ওঠে।
এদিকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে তাদের নিয়োগ চূড়ান্ত করতে প্রায় ১৪ মাস পর ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল ওই সব পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে আবেদন করেন প্রায় সাড়ে ৭শ’ চাকরিপ্রার্থী। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫শ’ টাকার ব্যাংক ড্রাফট নেয়া হয়। পরে সাড়ে ৩শ’ জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়।
কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার বাছাই বোর্ড ও সিন্ডিকেট সেই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্তদেরকেই চূড়ান্ত করে। অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কোথাও উল্লেখ করা হয়নি এসব পদ অভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের জন্য।
ওই নিয়োগ পরীক্ষায় সেকশন অফিসার (রেজিস্ট্রার কার্যালয়) পদে চাকরিপ্রার্থী সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী মওদুদ আহমেদ বলেন, নানা ভোগান্তি সহ্য করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আবেদনকারীরা মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাড়ে ৭শ’ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে প্রতারণা করে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তিনি জানান, পরে তারা বুঝতে পেরেছেন শুধু নিয়োগ বণিজ্যের লাখ লাখ টাকা হালাল করতেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল।
এডহক ভিত্তিতে ৩০ বছরের বেশি বয়সী প্রার্থীর নিয়োগ এবং অভ্যন্তরীন প্রার্থীর নাম উল্লেখ না করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক ভিসি বর্তমানে বাংলাদেশ এক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক ড. এম গোলাম শাহী আলম যুগান্তরকে বলেন, এটা অনেক দিন আগের বিষয়, এখন আর ওইসব মনে নেই। তবে নিয়মের বাইরে আমি কিছু করিনি। বয়স বেশি হলে তো নিয়োগ পাওয়ার কথা নয়।
অন্যদিকে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. মহিয়ার রহমান হাওলাদার বলেন, আমি শুধু তাদের নিয়োগ চূড়ান্ত করেছি। আগের ভিসির অনিয়ম হালাল করেছেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে অনেক অনিয়ম আগে থেকে এভাবেই হয়ে আসছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক ভিসির সময় প্রথম শ্রেণির ৫টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একই বছরের ১০ নভেম্বর এসব পদে নিয়োগে বাছাইবোর্ড গঠিত হয়। বাছাই বোর্ড ৫টি পদে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৫ নেতাকে নিয়োগের সুপারিশ করে।
নিয়ম অনুযায়ী সিন্ডিকেটে তোলা হয় বাছাই বোর্ডের সুপারিশ। কিন্তু সিন্ডিকেটে তোলার পর বয়স বেশি থাকায় আপত্তি ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি শামীম মোল্লার বিষয়ে। তবে, ৩১ বছরের বেশি বয়সে সাধারণ সম্পাদক ঋত্তিক দেবকে অনুমোদন দিয়েছিল সিন্ডিকেট।
বয়স বেশি থাকলে বাছাই বোর্ড কেন সুপারিশ করল জানতে চাইলে সিন্ডিকেটের সভাপতি বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. মহিয়ার রহমান বলেন, ‘তখন আমরা সেটা খেয়াল করিনি।’
ঋত্তিক দেবের বয়স বেশি থাকার পরও কিভাবে নিয়োগ পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় তারা ঋত্তিক দেবকে নিয়োগ দিয়েছেন। যদিও এর ১ মাস আগে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
বিষয়টি নজরে আনলে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. মহিয়ার রহমান বলেন, নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি যখন প্রকাশ করা হয় তখন কোটা পদ্ধতি ছিল তাই তিনি কোটায় নিয়োগ দিয়েছেন।
তবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বর্তমানে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. শহিদুল্লাহ তালুকদার বলেন, কোটা বাতিলের পর আর কোটায় নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই, কেউ সেটা করে থাকলে তা হবে অবৈধ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন