বাজারে আগুন দাম। বাড়তি টাকার আশায় সময়ের আগেই ক্ষেত থেকে তুলে ফেলা হচ্ছে পেঁয়াজ। শনিবার মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে ছবিটি তুলেছেন আশরাফুল আলম লিটন
পেঁয়াজের বাণিজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চলছে পেপারবিহীন লেনদেন। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানির প্রকৃত তথ্য না রেখে কেবল মুখে মুখে এ বাণিজ্য চলায় প্রশাসনের নানা চেষ্টাও ব্যর্থ হচ্ছে। উল্টো সরকারকে দুই অঙ্কে পেঁয়াজের দাম কমানোর ব্যবসায়ীদের আশ্বাসের কয়েকদিন পরই তা দুইশ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অথচ ভারত রপ্তারি বন্ধ করে দেওয়ায় গত দুই মাসে বিকল্প উৎস থেকে সোয়া লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে দেশে। এর মধ্যে গতকাল শনিবারও নিত্য এ পণ্যটি নিয়ে তিনটি জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, মিসর থেকে আসা তিনটি জাহাজের মধ্যে মেরিন বে-তে ১৩টি কনটেইনারে আছে ৩৭৯ টন পেঁয়াজ। মার্কস ব্লাডিবোস্তক জাহাজে ৫৮ টন ও বিএল গ্রেস জাহাজে আছে ৭৯ টন। আর এ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এ পর্যন্ত মোট সাড়ে সাত হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হলো। বন্দরটির টার্মিনাল ম্যানেজার খুদরাত-ই-খুদা মিল্লাত বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে মিসর থেকে আরও জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের পথে রয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেঁয়াজ আমদানিকে উৎসাহিত করতে সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২ অক্টোবর দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, দেশের স্থানীয় বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত ও মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পেঁয়াজ আমদানিতে অর্থায়নের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হলো। এ নির্দেশনা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। এর পরই দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এস আলম, সিটি গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খুলে বিভিন্ন ব্যাংকে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এসব এলসির মাত্র সাড়ে সাত হাজার টন পণ্য এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। মিসর, তুরস্কসহ বিকল্প কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আনতে এসব এলসি খোলা হয়েছিল।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলসির সব পণ্য আসতে আরও অন্তত ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে উড়োজাহাজে করে পেঁয়াজ আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যা দেশে আসবে আগামী মঙ্গলবার। তবে এতসব উদ্যোগের পরও পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হবে না বলেই ধারণা করছেন ক্যাবের সহসভাপতি এএসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘দেশের আমদানিকারকরা নিশ্চয়তা পাননি পেঁয়াজ আমদানি করলে তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন না। সরকার এ নিশ্চয়তা তাদের দেয়নি। এ সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। আবার সরকার অতি মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছে না।’
একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদন শুরু হয়েছে। কোনো কোনো রাজ্যে উদ্বৃত্তও আছে। কাজেই যে কোনো মুহূর্তে যদি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ঘোষণা দেয় তবে বাংলাদেশের সীমান্তপথ দিয়ে তা দ্রুত প্রবেশ করবে। অথচ এ সময়ে অন্য দেশ থেকে চড়া দামে পেঁয়াজ কেনা হচ্ছে। ওই পণ্য দেশের বাজারে আসার মুহূর্তে যদি ভারত থেকেও পেঁয়াজ আসা শুরু হয় তা হলে আমদানিকারকরা সম্পূর্ণভাবে পথে বসবেন। অতীতেও এ ধরনের উদাহরণ ব্যবসায়ীদের সামনে রয়েছে। বিদেশ থেকে চড়া দামে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করবে না এমন প্রতিশ্রুতি নেই।
দেশের বাজারে সংকট তৈরি করে গুদামে পচানোর পর বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অন্তত ২০ টন পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাই খালের আশপাশের ভাগাড়ে ফেলে দেন ব্যবসায়ীরা। অনেকেই পেঁয়াজ ফেলেছেন চাক্তাই খালে। তা কেউ কেউ কুড়িয়ে নিচ্ছে। তবে রাতে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে পচা দুর্গন্ধযুক্ত পেঁয়াজ নগরীর আরেফিননগর নিয়ে ময়লা ফেলার স্থানে ফেলে দিয়েছে। এ জন্য চারটি গাড়ি ব্যবহার করে করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ। খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিস আমাদের সময়কে বলেন, ‘এসব পেঁয়াজ কিছু দিন আগে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হয়েছে। জাহাজে করে আনার সময়ই অনেক পণ্য ভিজে গেছে। ফলে বিক্রির আগেই তা নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব পেঁয়াজ ফেলে দেওয়া হয়েছে।’ তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদ আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘ফেলে দেওয়া সব পেঁয়াজের আকার মিয়ানমারের পেঁয়াজের মতো নয়। অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজও দীর্ঘদিন রেখে দেওয়ায় পচে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় এগুলো গুদামজাত করেছিলেন মনে হয়। শেষে পচে গেছে।’
এদিকে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়ত থেকে পচা পেঁয়াজ ভাগাড়ে ও খালে ফেলে দেওয়ার পর গতকাল বিকাল থেকে দুই ঘণ্টায় অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালান জেলা প্রশাসকের দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আমদানি চালান দেখতে চান। তবে একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা তা দেখাতে পারেনি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গালিব চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘এর মধ্যে বার আউলিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৮৫ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রির তালিকা টাঙিয়ে ১৫০ টাকায় বিক্রি করছিল। এ জন্য তাদের ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তবে আজকে (শনিবার) জরিমানা করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আমরা বাজার মনিটর করছি। এ অভিযান চলমান থাকবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন