কার্গো পণ্য স্ক্যানিং নিয়ে ফের আন্তর্জাতিক ‘অ্যালার্ট’র তালিকায় নাম উঠার আশঙ্কা রয়েছে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরের। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সমুদ্র বন্দরগুলোতে স্থাপন করা নিম্নমানের কনটেইনার স্ক্যানার নিয়ে এ অ্যালার্ট জারি হতে পারে।
স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলোতে ইতিমধ্যে যেসব স্ক্যানার মেশিন বসানো হয়েছে সেগুলো নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন আবারও একই মানের ও একই দেশের স্ক্যানিং মেশিন বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে এসে এ শঙ্কার কথা জানিয়েছে।
তারা বলেছেন, দেশের আকাশ ও নৌপথের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড না হয় এবং নিম্নমানের মেশিন দিয়ে কার্গো পণ্য স্ক্যানিং করে তা বিদেশে পাঠানো হয় তাহলে ফের বাংলাদেশকে উচ্চঝুঁকির অ্যালার্টে রাখা হবে।
তবে শাহজালালের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দলটি। একই সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত আরও কিছু শর্ত দিয়ে গেছে।
বাংলাদেশকে ‘উচ্চঝুঁকি’র দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে আকাশ ও সমুদ্রপথে সরাসরি পণ্য পরিবহন (কার্গো) বন্ধ করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
পরে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে বিমান ও নৌ বন্দরগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। যুক্তরাজ্যের পরামর্শে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ওই দেশের বেসরকারি সিটিউরিটি সংস্থা রেডলাইনকে নিয়োগ করা হয়।
বসানো হয় ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন, ডুয়েল ভিউ স্ক্যানিং মেশিন, লিকুইড এক্সপেন্টাসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (এলইডিএস), আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং সিস্টেম (ইউভিএসএস), ফ্যাপ ব্যারিয়ার গেট উইথ কার্ড রিডার, ব্যারিয়ার গেট উইথ আরএফআইডি কার্ড রিডার, এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস), এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেকশন (ইটিডি) যন্ত্র বসানো হয়। পরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় দেশগুলো।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্টের (ডিএফটি) একটি প্রতিনিধি দল শাহজালাল বিমানবন্দর পরিদর্শন করে সেখানে স্থাপিত চায়নিজ একটি কোম্পানির দুটি ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম) মেশিনের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে।
তারা অবিলম্বে মেশিন দুটি পরিবর্তন করে উন্নতমানের কোম্পানির ও টিএসএ সার্টিফিকেশনধারী ইডিএস মেশিন স্থাপনের কথা জানান। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এরপরও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ মেশিন দুটি পরিবর্তন না করে উল্টো ওই কোম্পানি থেকে আরও ইডিএস মেশিনসহ বেশ কিছু সিকিউরিটি পণ্য ক্রয়ের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রস্তাব দিয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, একটি সিন্ডিকেট অনুদানের নাম করে ওই পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি নৌ বন্দরগুলোতেও এ সিকিউরিটি পণ্য বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রজেক্টের পিডিপিপি সম্পন্ন করছে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে চায়নিজ ওই কোম্পানিকে সুবিধা দিতে সিভিল এভিয়েশনের আসন্ন ক্রয় প্রক্রিয়াগুলোতে এভিয়েশন সিকিউরিটির অন্যতম শর্ত টিএসএ (ট্রাসপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) সার্টিফিকেশন বাদ দেবার পাঁয়তারা চলছে ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে আধুনিকায়ন ও এ গ্রেডের বিমানবন্দরে উন্নীত করার যে প্রক্রিয়া চলছে তা হুমকির মুখে পড়বে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ যে কোম্পানির কাছ থেকে সিকিউরিটি পণ্যগুলো ক্রয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে ওই কোম্পানিটি আন্তর্জাতিক এভিয়েশন অডিট বডি এফএএ ও ডিএফটির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এছাড়া ওই কোম্পানির কাছ থেকে ২০১২ সালে ক্রয় করা ইডিএস মেশিন দুটি নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক এভিয়েশন অডিট বডিগুলো। জানা গেছে, শাহজালাল কর্তৃপক্ষ ওই দুটি ইডিএস মেশিন ক্রয় করে ৩ মাসও ব্যবহার করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মেশিন দুটির নিম্নমানের সিকিউরিটি পারফরম্যান্সের কারণে রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠানগুলো এতে আপত্তি জানিয়েছে। সেই ইডিএস দুটি এখন ক্যাবের ভাগাড়ে স্থান পেয়েছে। যা কেজি দরে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ক্যাবের সামনে।
জানা গেছে, শুধু শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষই নয় চায়নিজ ওই কোম্পানির সিকিউরিটি পণ্য ক্রয় করার জন্য সরকারের আরও কয়েকটি বিভাগও কার্যক্রম শুরু করেছে।
জানা গেছে, কোম্পানিটি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে প্রথমে বিনামূল্যে মেশিন প্রদান করে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। এক বছর পর থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ও স্পেয়ার পার্টর্স দেয়ার নামে মেশিনের দাম উঠিয়ে নেয়।
বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সিকিউরিটি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- র্যাপিস্ক্যান, স্মিথ ও এল থ্রি হ্যারিস। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, শাহজালালসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর যারা এসব পণ্য ক্রয় করছে তারা দরপত্রে বা ক্রয় প্রস্তাবে এমন কিছু শর্ত দিচ্ছে কিংবা শর্ত শিথিল করে রাখছে যাতে উন্নত ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো অংশ নিতে আগ্রহী না হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্মাতা কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি যুগান্তরকে বলেন, সিকিউরিটি স্ক্যানিং মেশিনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় আমেরিকান সার্টিফিকেশন টিএসএ পেতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে চায়নিজ ওই কোম্পানি।
এছাড়া ইউরোপিয়ান সার্টিফিকেশন ইকেক’রও সার্টিফিকেশন ঠিকমতো অর্জন করতে পারেনি কোম্পানিটি। ওই কোম্পানির বেশিরভাগ পণ্যে সর্বোচ্চ ইকেক সার্টিফাইড-২ রয়েছে।
যদিও বিশ্ব বাজারে ২০১৬ সাল থেকে ইকেক সার্টিফাইড-তিন চলছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও ইতিমধ্যে চায়নিজ ওই কোম্পানির সিকিউরিটি পণ্য ক্রয় করা বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারতীয় সিভিল এভিয়েশন অথরিটি ২৯২টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন ক্রয় করলেও পরবর্তীতে নিম্নমানের নিরাপত্তার কারনে কোম্পানিটিকে নিরাপত্তা ছাড়পত্র দেয়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন