রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১৬ সালের জুনে ৩৪০ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয় একনেকে। এ প্রকল্পের আওতায় ১০ তলাবিশিষ্ট ১২টি স্থাপনাসহ ১৪টি ভবন নির্মাণের কথা আগামী বছরের জুনের ভেতর। কিন্তু গত ৪ বছরে তিনতলাবিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল সেন্টার নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। অন্যান্য স্থাপনার কোনো খবর নেই। এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের দৃশ্যত অগ্রগতি না হলেও আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪ শতাংশ। ভবন নির্মাণ সম্পন্ন না হলেও প্রায় ১২ কোটি টাকার ল্যাব সরঞ্জাম কেনাকাটা শেষ। পাশাপাশি প্রকল্পের জন্য নতুন করে ২৫৯ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প অনুমোদন ৪ বছর হলেও আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। ৪ বছরে ১৪টি স্থাপনার মধ্যে একটির কাজও এখনো শুরু হয়নি, অথচ নতুন করে আরও দুটি হোস্টেল (প্রতিটি ১০ তলাবিশিষ্ট ১০ তলা) নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে ২টি আবাসিক ভবন (প্রফেসর’স, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর’স কোয়ার্টার এবং অফিসার্স কোয়ার্টার) নির্মাণের প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত প্রস্তাবে বেশকিছু অসঙ্গতিও পেয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা উইং। এ বিষয়ে মত দিতে গিয়ে জানানো হয়, মূল অনুমোদিত প্রকল্পে বৈজ্ঞানিক ও ল্যাব সরঞ্জাম ক্রয়ের অংশে ৩ হাজার ৬৯৯টি আইটেমের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৬৭ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। এর থেকে ১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের ১ম সংশোধিত ডিপিপিতে ২ হাজার ৭১৪টি আইটেমের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর যৌক্তিকতাও জানতে চেয়েছে কমিশন। এ ছাড়া আগের তালিকার অনেক সরঞ্জাম বর্তমানে আউটডেটেড এবং বিভাগীয় প্রধানদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আইটেম সংশোধন করা হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের সময় বৈজ্ঞানিক ও ল্যাব যন্ত্রপাতি ক্রয়ের তালিকা প্রণয়ন ও ব্যয় প্রাক্কলন কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল তাও জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া ৫৫ লাখ টাকায় একটি পিকআপ কেনার সংস্থান ছিল। কিন্তু সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় ৫৮ লাখ ৭০ হাজার টাকায় একটি পিকআপ ক্রয় করে প্রস্তাবিত সংশোধিত ডিপিপিতে সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়। অনুমোদিত অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থে পিকআপ ক্রয় পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী উল্লেখ করে এর কারণও জানতে চায় পরিকল্পনা কমিশন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের প্রায় ৩০ শিক্ষক থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘পরিকল্পনা ও উন্নয়ন’ বিভাগের এবং ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’-এর পরিচালক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ পরিকল্পনা এবং অভিজ্ঞতার অভাবেই তিন বছরেও অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি স্থাপনা নির্মাণের কাজ সংশ্লিষ্ট দপ্তর শুরু করতে পারেনি। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। তাদের কর্মকা- দেখে মনে হচ্ছে ‘বাতির নিচে অন্ধকার’।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৪টি ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল জুন ২০১৬ থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ১৪টি স্থাপনার মধ্যে কেবল তিনতলাবিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল সেন্টারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। উপাচার্যের ডাকবাংলো নামে দুই তলাবিশিষ্ট একটি ভবনের কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ‘রিথিন এন্টারপ্রাইজ’ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই দুটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করার দায়িত্ব পায়। প্রতিষ্ঠানটি বাকি ১২টি স্থাপনার জন্য অতিরিক্ত বাজেট চেয়েছে। ১২টি স্থাপনার মধ্যে ১০ তলাবিশিষ্ট ৩টি একাডেমিক ভবন, ১টি প্রশাসনিক ভবন, ৪টি আবাসিক হল, ১টি ইনস্টিটিউট ভবন, ১টি ডরমেটরি রয়েছে। এসব ভবন নির্মাণের সময়কাল ছিল জুন ২০১৬ থেকে জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের রেট অনুযায়ী, গত ২ অক্টোবর তিনতলাবিশিষ্ট মেডিক্যাল সেন্টারটি নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এবং উপাচার্যের ডাকবাংলো নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি পরিষ্কার করা হচ্ছে।
প্রায় ৪ বছরেও কেন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, ‘আমি গত বছরের ৩০ জুলাই উপাচার্য হিসেবে যোগদান করি। ১৪টি স্থাপনার ডিজাইন তৈরির কাজগুলো পেয়েছিল ‘ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট (ডিডিসি)’ ফার্ম। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ডিডিসির দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা আমাদের আর্কিটেকচারাল ভিউ, ডিজাইন দেখায়। ২০১৪ সালের রেট অনুযায়ী আমাদের প্রকল্পটির অনুমোদন হয়েছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম ২০১৮ সালের রেটও পাস হয়ে গেছে। স্থাপনাগুলোর ডিজাইন হওয়ার পর আর্কিটেকচারের ভিউটা সুন্দরই ছিল, কিন্তু বিল্ডিংগুলো তৈরির জন্য যে স্পেস নির্ধারণ করা আছে সেই অনুযায়ী যদি এগুলো তৈরি করি তা হলে এটা গোয়ালঘরের মতো বিষয়টা হয়ে যাবে।’
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এটি একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় যে জিনিসটি তৈরি হবে মানুষ তা অনুসরণ করবে। আমরা যদি খারাপ জিনিস তৈরি করি তা হলে যুক্তিসঙ্গত হবে না। আর এই পরিকল্পনা হবে ১০০ বছরের। ১০০ বছরের জন্য যে জিনিসটি করব তা ভালো না হলে তৈরির সার্থকতা থাকে না।’
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের জুন মাসে ১৪টি স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। কিন্তু আগের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ওই প্রশাসন তা হলে এই দীর্ঘ সময় স্থাপনাগুলো নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেনি কেন? এমন প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, ২০১৬ সালের শেষে দিকে আগের প্রশাসন হয়তো প্রকল্পের কাগজপত্র হাতে পেয়েছিলেন। এর মধ্যে কনসাল্টিং ফার্মকে কাজগুলো দিতে দেরি হয়। মাঝখানে আবার উপাচার্য দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ছিলেন। আমাদের অভিজ্ঞতাও হয়তো প্রথম। সবকিছু মিলিয়ে কাজ শুরু করতে হয়তো দেরি হয়েছে।
কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে রুয়েটের প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার অমিত রায়চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেছেন, প্রতি দুই মাস পরপর মন্ত্রণালয়ে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করতে হয়। প্রকল্প সম্পর্কিত কোনো তথ্য দিতে হলে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি লাগবে।
দুই দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নির্দেশ
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ প্রায় ৪ বছরেও কেন শুরু করা যায়নি তার ১০টি কারণ লিখিত আকারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। দুই দিনের মধ্যে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রুয়েটের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী অমিত রায়চৌধুরী বলেছেন, ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় প্রকল্পের কার্যক্রম বিলম্বের ১০টি কারণ জানতে চেয়েছেন। আমি এখন জবাব লিখছি।
প্রকল্পের অধীনে ১২ কোটি টাকার কী কী ধরনের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে- এমন প্রশ্নে প্রকৌশলী অমিত রায়চৌধুরী বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ১৪ বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ৬৭ কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব বিভাগে ল্যাবরেটরির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিছু যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তাই অ্যাকুরেট হিসাবটা এই মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সময় লাগবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যে ১০টি কারণ জানতে চেয়েছে, তার তিনটি কারণ আমি লিখেছি। আরও সাতটি কারণ লিখতে হবে।
নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে এই প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘এমন কিছু লিখবেন না, যাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণœ হয়। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজটি সম্পন্ন করতে পারলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন ভালো হবে, তেমনি উত্তরাঞ্চলের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন