মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এটিএম (টাকা উত্তোলনের মেশিন) ও সিআরএম মেশিন (টাকা উত্তোলন ও জমা) আমদানির নামে অর্থ পাচার করেছে জারা জামান টেকনোলজি লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি বড় ধরনের শুল্কও ফাঁকি দিয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগের পর তা খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জারা জামান টেকনোলজি লিমিটেড ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর চীনের জিআরজি ব্যাংকিং ইকুইপমেন্ট (এইচকে) নামের একটি কোম্পানির কাছ থেকে ৩২ পিস এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন) এবং ১৭ পিস সিআরএম (ক্যাশ রিসাইক্লার মেশিন-টাকা উত্তোলন ও জমা) মেশিন ক্রয় করে।
কোম্পানির চালান মূল্যে দেখা গেছে, প্রতিটি এটিএমের ক্রয়মূল্য ৩ হাজার ৫৭০ ডলার। সে হিসাবে ৩২টি এটিএমের মোট মূল্য ১ লাখ ১৪ হাজার ২৪০ ডলার। কিন্তু এলসিতে প্রতিটি এটিএমের মূল্য দেখানো হয়েছে ১১শ’ ডলার। সে হিসাবে ৩২টি এটিএমের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার ২শ’ ডলার।
একইভাবে, প্রতিটি সিআরএম মেশিনের ক্রয়মূল্য ১২ হাজার ৫৫০ ডলার। সে হিসাবে ১৭টি সিআরএম মেশিনের মূল্য ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৫০ ডলার। কিন্তু প্রতিটি সিআরএম মেশিনের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৫শ’ ডলার। সে হিসাবে ১৭টি সিআরএম মেশিনের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৪২ হাজার ৫শ’ ডলার।
ওই কোম্পানির শর্তে বলা হয়, পণ্য সরবরাহের পূর্বে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে। ঢাকা মহাখালীর ২ বীর উত্তম একে খন্দকার সড়কের ঠিকানায় পণ্যগুলো আমদানি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানটি আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বেশি (৭৯ হাজার ৪০ ডলার ও ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৩০ ডলার) পাচার করেছে। পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও ফাঁকি দিয়েছে।
পণ্যের মূল্য নিয়ে মিথ্যা ঘোষণা প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হয় জারা জামান টেকনোলজি লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩ বছর মেয়াদি (২০১৯-২১) মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করেছে। সেখানে বিশেষ করে ট্রেডিংয়ের অন্তরালে অর্থ পাচার প্রতিরোধে ১১টি পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা থাকছে। ইতিমধ্যে এর অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শিগগিরই এটি জারি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যাংক মাধ্যমকে বেছে নেয়া হয়। এজন্য ব্যাংকগুলোকে অর্থ পাচার প্রতিরোধে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন আইন সংশোধনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফইউ) সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ‘জাতীয় কৌশলপত্র’ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ৪১টি ঝুঁকি শনাক্ত করা হয়। খসড়া কৌশলপত্রে বলা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্তরালে মানি লন্ডারিং মূলত আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হয়, সেটি বের করা হবে।
শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, সফটওয়্যার, শিল্পের ডিজাইন, কম্পিউটার এক্সেসরিজ ও পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কর কম আরোপ করার মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এসব খাত খতিয়ে দেখা হবে।
এগুলো বন্ধে ১১টি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয় ওই কৌশলপত্রে। এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে- ব্যাংকগুলোতে এলসিতে দেয়া মূল্য অধিক যাচাই-বাছাই করা ও প্রত্যেক বাণিজ্যিক ব্যাংকে নিজস্ব ডাটাবেজ স্থাপন। পণ্যের আমদানি-রফতানি মূল্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রতিটি ব্যাংককে নিজস্ব ডাটা ব্যাংক স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পাশাপাশি কাস্টম কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশ রয়েছে ওই কৌশলপত্রে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
অর্থ পাচার প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, মানি লন্ডারিং ও টাকা পাচার প্রতিরোধে যে আইন হয়েছে তার বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। আগের তুলনায় দেশ থেকে পুঁজি পাচার বেড়েছে। দুর্নীতিবাজরা হুন্ডির মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করছে। তাদের আত্মীয়-স্বজন বিদেশে আছে, তাদের মাধ্যমে ডলার বিদেশ থেকে গ্রহণ করছে। দেশ থেকে পরিশোধ করছে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে বেড়েছে মানি লন্ডারিংও।
তিনি আরও বলেন, বেগমপাড়া, কুয়ালালামপুর, টরেনটোতে কারা বাড়ি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযান চালালে বের হয়ে আসবে। কোরিয়া, উগান্ডা, নেপালসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছেন। এখানে এফবিসিসিআইয়ের অনেক সদস্যও আছেন। সন্ধান চালালে এসব টাকা পাচারকারীকে সহজে শনাক্ত করা যাবে। এসব দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে।
অর্থ পাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রেটির (জিএফআই) তথ্য মতে, বিশ্বব্যাপী মোট পাচারকৃত অর্থের ৮৭ শতাংশ অর্থ পাচার হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে। এটি ২০১৫-১৬ সালের বিশ্বব্যাপী মোট বাণিজ্যের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ২০০৬-২০১৬ সময়ের হিসাবে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ পাচার হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্তরালে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন