বেশ জোড়ালোভাবেই রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য এবং টেন্ডারবাজিসহ নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছিল। দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দূনীর্তির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর অনমনীয় মনোভাব সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছিল। দেশবাসির পাশাপাশি দল থেকে আগাছা নির্মূলের এ অভিযানে ত্যাগি নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি করেছিল উৎসাহ উদ্দিপনা। এতে দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন অনেকেই। কিন্তু দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আলোচিত অভিযান কি হঠাৎ করেই থমকে গেছে? অনেকের মনেই এখন এ প্রশ্ন।
দূর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও এ অভিযানটি পরে ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সেটাও এখন আর দৃশ্যমান নয়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে সরকারের রাজনৈতিক চিন্তা কি, তাও পরিস্কার করা হচ্ছে না।
ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে চাঁদাবাজির অভিযোগে সরিয়ে দেয়ার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকায় এর বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে অপসারণের মধ্য দিয়ে যে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়।এরই ধারাবাহিকতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী দুর্নীতি ও ক্যাসিনো-সংশ্নিষ্টতায় খালেদ, মিজান, শামীম, সম্রাট প্রমুখকে গ্রেফতার করেছে।
সেই প্রেক্ষাপটে শুরু করা হয় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য পরিচালনা এবং টেন্ডারবাজির অভিযোগে যুবলীগ এবং কৃষক লীগের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোর অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। কার্যত অভিযানটি পরেক্যাসিনোর বিরুদ্ধে ক্লাবগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আর এখন অভিযান আদৌ চলছে কিনা, সেই প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবায়দা নাসরীন বলেন, সরকার আসলে কতদূর যাবে, সেটা পরিস্কার করা হচ্ছে না। ফলে রাজনৈতিকভাবে একটা সাময়িক কৌশল হিসেবে এই অভিযান চালানো হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, সরকারের যে লক্ষ্য, সেটির মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী বা বড় ধরণের সংস্কারের পক্ষে অবস্থানের বিষয়টি খোলাসা হচ্ছে না। কারণ যখনই ছোট ছোট বা টুকরো টুকরো বিষয়ে পদক্ষেপ হচ্ছে, যেমন ছাত্রলীগের দু'জন নেতাকে সরিয়ে দেয়া হলো,বা যুবলীগের মধ্যে ব্যবস্থা — সেগুলো সরকারের স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু এর দীর্ঘ মেয়াদী কোনো প্রভাব আছে বলে মনে হচ্ছে না।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখা এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেছিলেন।তিনি এমন মন্তব্যও করেছিলেন যে, ওয়ান-ইলেভেনের প্রয়োজন হবে না। কারণ তাঁর সরকারই দুর্নীতি দমন করবে এবং এই অভিযানে কাউকে ছাড় দেবে না।
অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান মূলত চাপা পড়ে যায় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হতকাণ্ডের পর পর। বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসের জেরে ছাত্রলীগের নেতারা আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর আলোচনার লাইম লাইটে ওঠে আসা আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। বুয়েট শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনা এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। এই ঘটনার পর আলোচনা থেকে হারিয়ে গেছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। অভিযানের কোন কিছু এখন দৃশ্যমানও নয়।ফলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও বিশ্লেষকদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
সরকারের দায়িত্বশীল কর্তার দাবি করছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের কারণে এতে কিছুটা ধীর গতি আসতে পারে, কিন্তু অভিযান থমকে যায়নি।এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়েই এগুচ্ছে। মোটেও সেখান থেকে সরে আসেনি। ক্লাবগুলো ক্যাসিনো-বাণিজ্যের মতো অনৈতিক কাজ হতো, সেগুলো ইতিমধ্যে বন্ধ হয়েছে। এখন গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।আরও কেউ জড়িত আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযান থামলো কোথায়?"
তিনি আরও বলেন, শুধু ক্যাসিনো বা ক্লাবে এই অভিযান সীমাবদ্ধ নয়। দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং মাদকের বিরুদ্ধে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। এই অভিযান শুধু দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নয়। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে এই অভিযান চলবে।
দূর্নীতিবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে পুলিশ এবং র্যাবের কর্মকর্তারাও একই ধরণের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।তারা বলছেন, দূনীর্তিবাজদের ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েই পুলিশ এবং র্যাব অভিযানে নামে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ থেমে নেই, এ অভিযানের সমাপ্তিও টানা হয়নি।
প্রশ্ন ওঠেছে, দেশে দায়িত্ব দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের। এই প্রতিষ্ঠানটি থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আলাদাভাবে দূনীতির বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে হলো? দুদক দূর্নীতি দমনে জোরালো ভূমিকা রাখছে না?
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমাদের আইনগত কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। দুদক যে কোনো অভিযোগ অনুসন্ধানের আগে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পক্ষে মামলা করা সম্ভব নয়। কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেই আমাদের আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান করতে হয়।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে দুদকের নিরব ভূমিকায় ছিল, এর কারণ জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ফৌজদারি অপরাধ তদন্ত আমাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত না। ক্যাসিনো দুদকের তফসিলভুক্ত নয়। নব অপরাধ তো দুদকের আওতায় আসে না।
ইকবাল মাহমুদ আরও বলেছন,পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্নসূত্রে আমরা পেয়েছি, ৪৩ জন অবৈধ আয় করেছে। সেগুলো আমরা অনুসন্ধান করছি। তাদের কেউ ক্যাসিনোর সাথে জড়িত থাকতে পারে।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবি'র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর কিছু নেতাকর্মীর অপরাধমূলক কর্মকান্ড এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা বলা হলেও তা পরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্যদিকে নেওয়া হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় টার্গেট নিয়ে অভিযান চালানোর কথা বলে তা ক্লাবগুলোর মধ্যে ছোট পরিসরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তো তাও বন্ধ। এতে দূর্নীতি দমনে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
ক্যাসিনো আর ম্যাসেজ পার্লার পর্যায়ে দূনীতি দমন অভিযান পরিচালিত হওয়ায় সমালোকচকদের কেউ কেউ বিষয়টিকে একধরনের আইওয়াশ বলেও মনে করছে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পরই অভিযান চালানো হচ্ছে, সেজন্য ধীরগতি মনে হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতিটা বাংলাদেশের কাঠামোগত। বাংলাদেশে এই ধরনের অভিযান জনগণকে তুষ্ট করার জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয় কিন্তু এই সব অভিযানে মূলত রাস্তা ঘাটের অপরাধের দিকে মনোযোগ দেয়া হয়। ব্যাংক ঋণ আর নির্মাণের সাথে জড়িত বড় দুর্নীতিগুলোতে হাত দেয়া এখনও প্রায় অসম্ভব। এটা শুধু রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সিস্টেমকে হুমকিতে ফেলবে না বরং রাজনৈতিক কাঠামো নিজেই হুমকিতে পড়ে যাবে।
তারা মনে করেন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে রাজনীতিকে অনিয়ম-অগণতান্ত্রিকতা-দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে- রাজনীতি ঠিক না হলে সমাজ ঠিক হবে না, উন্নয়নের দুর্নীতি দূর হবে না, ছাত্রলীগ-যুবলীগও ঠিক হবে না। সঙ্গত কারণেই পুলিশি অভিযানের পাশাপাশি রাজনীতিতেও চাই সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযান। বাংলাদেশের দুর্নীতির অবস্থা যেমন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে, সেখানে এটা হতে পারে যে, দুর্নীতি দমন অভিযানের নিজেরই কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন