বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে রাজশাহীর দু’জনের নাম এসেছে। এদের নামে মামলাও হয়েছে। এরা হলো, বুয়েট ছাত্রলীগের প্রচার ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার এবং অপরজন ছাত্রলীগকর্মী মেহেদী হাসান রবিন। এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে অনুতাপ প্রকাশ করেছেন দুজনেরই পরিবার। নিজের সন্তান কিংবা ভাই-পরিজন হলেও পরিবারের প্রত্যাশা- দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
এদের মধ্যে অনিক ঘটনার দিনই গ্রেফতার হন আর পরে রবিনকে গ্রেফতার করা হয়। এখন এই দুই হত্যাকারীর পরিবার চরমভাবে অনুতপ্ত। আবরার হত্যার পেছনে তাদের ছেলেদের নাম দেখে হতবাক হয়েছেন পরিবারর সদস্যরা। আর মুষড়ে পড়েছেন তাদের বাবা-মা। এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, এত মেধাবী ছেলেরাও আরেকজন মেধাবী ছেলেকে পিটিয়ে হত্যার মতো লোমহর্ষক ঘটনার সঙ্গে কীভাবে জড়িত হতে পারে।
পরিবারের ভাষ্য, কোনও অসৎ চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়েই হয়তো এই হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন অনিক ও রবিন। তবে ঘটনাটির তারা সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার দাবি করেছেন। অপরাধী হলে শাস্তিরও দাবি করেছেন। পরিবারগুলো বলছে, বুয়েটের প্রত্যেক শিক্ষার্থীই কারও না কারও সন্তান। তবে সন্তান হলেও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে তারা যেন পার পেয়ে না যায় সেটাই চাওয়া তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হত্যায় জড়িত অনিক সরকারের বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বড়ইকুড়ি গ্রামে। অনিক ওই গ্রামের বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আনোয়ার হোসেনের ছেলে। আনোয়ার হোসেনের গ্রামের বাড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। ব্যবসার জন্য তিনি পরিবার নিয়ে মোহনপুর উপজেলা সদরের বড়ইকুড়ি গ্রামে থাকেন। অনিকরা দুই ভাই। এর মধ্যে অনিক ছোট। তার বাবা আনোয়ার হোসেনের কাপড়ের দোকান রয়েছে। আছে পেট্রোল পাম্প এবং সারের ব্যবসাও। ব্যবসার অর্জিত অর্থ দিয়েই দুই ছেলেকে পড়ালেখা করান আনোয়ার হোসেন।
জানা গেছে খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ এই আনোয়ার হোসেন। ছোট ছেলে অনিককে নিয়েই পরিবারের বড় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরা হতে চলেছে। আবরার ফাহাদকে হত্যাকাণ্ডের জড়িত থাকায় গ্রেফতার হওয়ার পরে পরিবারের সব স্বপ্নই মূলত: এখন দুঃস্বপ্ন।
অনিকের বাবা আনোয়ার হোসেন ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘ছেলেকে পাঠিয়েছি পড়ালেখা করতে। কে জানতো সে এ ধরনের অমানবিক কাজে জড়িয়ে যাবে! সব বাবা-মা চায় তার সন্তান ভালভাবে পড়ালেখা করে পাস করে আসুক, বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করুক। কিন্তু অনিক এমন হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে ভাবতেও পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘কারও সন্তান যেন এমন না হয়। আইন সবার জন্য সমান। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার ছেলে অপরাধী হলে প্রচলিত আইনে তার যে সাজা হবে আমি মেনে নেবো। আমি চাই আমার ছেলের বিচার হোক। আমি আশা করবো অনিকের মত আর কেউ যেন ভুল পথে না যায়।’
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অনিক রাজশাহীতে থাকা অবস্থায় কোনও রাজনীতি করতো না। কারও সঙ্গে তেমন মিশতোও না। লেখাপড়া নিয়ে মগ্ন থাকতো। কী করে সে রাজনীতিতে প্রবেশ করলো তা জানি না। আমরা জানি অনিক সেখানে পড়ালেখা করছে। যখন জানতে পারলাম অনিক তারই সহপাঠি আবরারকে হত্যা করেছে তখন কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না যে আমার ছেলে কাউকে খুন করতে পারে। এখন আশপাশের সবাই বলছে, আমার পরিবার নাকি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন অনেক অপপ্রচারই চালানো হচ্ছে।’
তিনি কঠোর হয়ে বলেন, ‘ছেলের অপরাধে বাবা-মা ও তার পরিবারের বিচার করবেন না। আমরা আওয়ামী লীগ পরিবারের মানুষ, আজীবন আওয়ামী লীগেই থাকতে চাই। একটা ফুলে ১০ টা কুড়ি হলে ১০ টাইতেই ফল হয় না। অনিকও কুড়ি ছিল, ফল হতে পারেনি। পরিবারের সবাই সমান নয়। একজনকে দিয়ে পরিবারের সবার বিচার করা উচিৎ নয়। আমি আমার ছেলের প্রচলিত আইনে বিচার চাই।’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, অনিক সরকার ওরফে অপু ছোট থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিল। সে মোহনপুর কেজি স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণিতে ট্যালেনপুলে বৃত্তি পেয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ৮ম শ্রেণিতেও ট্যালেনপুলে বৃত্তি পায়। ২০১৩ সালে একই বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে। পরবর্তীতে ঢাকা নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকেও জিপিএ-৫ পেয়ে ২০১৫ সালে এইচএসসি পাস করে। একই বছরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এ ভর্তি হয়। বর্তমানে সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র।
মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মেহবুব হাসান রাসেল ব্রেকিংনিউজকে জানান, অনিক অপরাধী হতে পারে। প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। কিন্তু অনিকের বাবা আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। এমনকি তার পরিবারের প্রবীণ সদস্যরাও আওয়ামী লীগ করে আসছেন।
অনিকের মামা মোহনপুর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আল মোমিন শাহ্ গাবরু ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘আমি ১৯৯১ ও ১৯৯৫ সালে মোহনপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। ২০০৩ ও ২০১৫ সালে উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এখনও দায়িত্বে আছি। অনিকের বাবা আনোয়ার হোসেন আমার দুলাভাই। যখন আওয়ামী লীগের কোনও পার্টি অফিস ছিল না তখন দুলাভাইয়ের দোকান আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তার টাকা ছাড়া মোহনপুরে আওয়ামী লীগের কোনও জাতীয় দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি। অনিকের চাচা বেলাল হোসেন সরকার মোহনপুর উপজেলা যুবলীগের দুইবারের সাবেক সভাপতি, বর্তমান রাজশাহী জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে আছেন।’
আবরার হত্যায় আরেক অভিযুক্ত মেহেদী হাসান রবিনের বাড়িও রাজশাহী মহানগরীর অদূরে কাটাখালি থানার কাপাশিয়া পূর্বপাড়ায়। এই গ্রামটি পবা উপজেলার কাটাখালি পৌরসভা এলাকার মধ্যে। রবিনের বাবা মাকসুদ আলী পুঠিয়া উপজেলার ভড়ুয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তার একমাত্র সন্তান রবিন। রবিন বাবার স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করে রাজশাহী সরকারি নিউ গর্ভমেন্ট ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এরপর বুয়েটে ভর্তি হয়। আর মাত্র সাত মাস পরেই রবিন বুয়েট থেকে পাস করে বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার খবরে রবিনের পরিবারেও এখন নেমে এসেছে হতাশার ছাপ।
এ ঘটনার পর থেকে রবিনের বাবা শিক্ষক মাকসুদ আলীও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘শুনছি আমার ছেলে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কেন সে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হবে? আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না সে এমন একটি ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হতে পারে। তাকে তো আমরা পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার করতে ঢাকায় পাঠিয়েছি। কিন্তু সে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে কখনোই ভাবতে পারিনি।’ তিনিও ছেলের অপরাধের জন্য আইন অনুযায়ী শাস্তি প্রত্যাশা করছেন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন