আবরারের লাশ রেখে খুনিদের সঙ্গে কথোপকথন, যা বললেন শিক্ষক মিজানুর
10 Oct, 2019
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের রক্তাক্ত লাশ পাশে রেখেই খুনিরা আলাপচারিতায় মেতে উঠেন শের-ই বাংলা হলের প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান এবং ছাত্রকল্যাণের পরিচালক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। এ সময় আবরারকে হাসপাতালে নেয়ার কোনো উদ্যোগ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগের ঘাতক নেতাদের সঙ্গে হল গেটে রাত পার করেন প্রভোস্ট ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক।
আবরার হত্যাকাণ্ড নিয়ে সবশেষ প্রকাশ হওয়া ভিডিওতে এ চিত্র উঠে এসেছে। ভিডিও ফুটেজে নিজের উপস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুয়েট ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
তিনি জানান, ৬ অক্টোবর রাত পৌনে ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ এবং সহকারী প্রাধ্যক্ষ তার বাসায় যান। সহকারী প্রাধ্যক্ষ তাকে জানান, তার হলে একটি মার্ডার (হত্যা) হয়েছে। এরপর প্রাধ্যক্ষ এবং সহকারী প্রাধ্যক্ষকে নিয়ে তিনি শের-ই বাংলা হলে যান।
এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বুধবার দুপুরে বুয়েটের শহীদ মিনারের পাশের রাস্তায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন শিক্ষক মিজানুর।
এ সময় ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যাদের ছবি তোমরা দেখাচ্ছ, তারা সবাই ওখানে ছিল। তাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটি ডাক্তার। ডাক্তার আবরারের নাকে, বুকে হাত দিয়ে বলেন, ছেলেটা অনেকক্ষণ আগে মারা গেছে। এ সময় যারা উপস্থিত ছিল, তারা ডাক্তারকে চাপ দেয়, লাশ যেন এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দেন, তার একার পক্ষে এ ডেডবডি (লাশ) নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘ডাক্তার যখন বললেন আবরার মারা গেছে, তখন ছেলেরা ( ঘাতক ছাত্রলীগ নেতারা )আমাদের লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রেসার দিচ্ছিল। আমি বললাম, এটা পুলিশ কেস, আমি লাশ সরাতে পারব না। আমি ভিসিকে ফোন করে বিষয়টি জানালে তিনি পুলিশকে ফোন করতে বলেন। এরপর প্রধান সিকিউরিটি গার্ড আসেন। চকবাজার থানায় খবর দেয়া হয়।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘আবরারের ট্রাউজারের একটা অংশ যখন ওঠানো হয়, তখনই বুঝতে পারি আবরারের গায়ে মারের দাগ আছে। পরে লাশ ক্যান্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা হয়। সুরতহাল তৈরি করার সময় হলের প্রাধ্যক্ষ, সহকারী প্রাধ্যক্ষ, ডাক্তারের সঙ্গে আমিও ছিলাম। কখন লাশ নিতে পারবে সে ব্যাপারে উপর থেকে ইনস্ট্রাকশন (নির্দেশনা) চাচ্ছিল তারা। কিছুক্ষণ পর পুলিশের গাড়িতে একজন সিনিয়র কর্মকর্তা আসেন। পুলিশের গাড়িতে লাশ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।’
সূত্র বলছে, ৬ আগস্ট রাতে অমিত সাহার রুমে প্রথম দফায় মারধরের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। তার সঙ্গে মারধর শুরু করেন বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ও উপসমাজ সেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল।
পরে যোগ দেন অনিক, জিওন, মনির এবং মোজাহিদুলসহ অন্যরা। প্রথম দফায় মারধর চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। এরপর রাতের খাবার খাওয়ানো হয় আবরারকে। খাওয়ানো হয় ব্যথানাশক ট্যাবলেটও। দেয়া হয় মলম। দ্বিতীয় দফা মারধর শুরুর সময় অনিক ছিলেন সবচেয়ে মারমুখী।
আবরার এ সময় বারবার বমি করছিলেন। একপর্যায়ে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় মুন্নার কক্ষে। সেখানে আবরারের শরীরের ওপর অনিক ক্রিকেট স্ট্যাম্প ভাঙেন। পরে আরেকটি স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। তৃতীয় দফার মারধর শুরু হয় মুন্নার কক্ষে। তখন মধ্যরাত।
নির্মম পিটুনিতে আবরার লুটিয়ে পড়েন। এরপর নিথর দেহ টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন ঘাতকরা। মাঝ সিঁড়িতে যেতেই তারা বুঝতে পারেন আবরার মারা গেছেন। সিঁড়িতেই মরদেহটি রেখে তখন ওই স্থান ত্যাগ করেন তারা।
সূত্র জানায়, এরপর এ নিয়ে তারা যোগাযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে। সংশ্লিষ্টরা ঘাতকদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তোমাদের কিছুই হবে না। তোমরা হলেই অবস্থান কর।
এদিকে ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, যারা নির্বিঘ্নে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারাই রাতে দীর্ঘ একটি সময় কাটিয়েছেন হল প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান ও বুয়েট ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। ঘটনার পর তারা বেরিয়ে হলের গেটেই অবস্থান করেন।
সকালের দিকে হল সরগরম হয়ে উঠলে শুরু হয় ঘাতকদের ছোটাছুটি। সবচেয়ে বেশি মারধর করা অনিক ওরফে মাতাল অনিক দৌড়ে চলে যান তার রুমের দিকে। পরে ডাকা হয় ডাক্তার। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা ওই ডাক্তার আবরারকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন।
এর ২ মিনিট পর খুনিরা একটি স্ট্রেচারের ব্যবস্থা করেন। স্ট্রেচারটি সিঁড়ির মুখে বারান্দায় রাখা হয়। এর ২০ মিনিট পর লাশের কাছে আসেন প্রভোস্ট জাফর ইকবাল খান এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক মিজানুর রহমান।
পরে প্রভোস্ট এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালককে খুনিরা নিজেদের মতো করে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকেন। চশমা পরা রাসেল এবং সবচেয়ে বেশি মারধর করা অনিককে প্রভোস্টের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে দেখা যায়।
এ সময় পাশে ছিল অন্য খুনিরাও। ঢেকে রাখা কাপড় সরিয়ে আবরারের নিথর দেহে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেও অনেকটা নির্ভার ভঙ্গিতে ছিলেন প্রভোস্ট এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক। ডিবির একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আবরার ছিল খুনিদের টার্গেটে।
তাদের ধারণা ছিল সে ছাত্রশিবির বা অন্য কোনো ইসলামী ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে তেমনটিই মনে হয়েছিল খুনিদের কাছে। এজন্য তারা আবরারকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল।
এরই অংশ হিসেবে ওই দিন আবরারকে ডেকে পাঠানো হয়। আবরার ২০১১ নম্বর কক্ষে যাওয়ার পরপরই তার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়া হয়। ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রথমে তাকে শিবির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জেরা করা হয়। এরপর শুরু হয় মারধর।
এ বিষয়ে ডিবি দক্ষিণের উপ-কমিশনার জামিল হাসান বলেন, হত্যার মোটিভ নিয়ে তদন্ত চলছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করেই খুনিরা আবরারকে ডেকে নেয়। তার কাছ থেকে কিছু তথ্য আদায় করে। আরও তথ্য আদায়ের জন্য নির্যাতন করে। একপর্যায়ে আবরার মারা যায়। উপ-কমিশনার বলেন, তদন্তের আরও গভীরে গেলে অনুদ্ঘাটিত বিষয় জানা যাবে।
প্রসঙ্গত ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় খুন হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করে শনিবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ফাহাদ। এর জের ধরে রোববার রাতে শেরেবাংলা হলের নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে তাকে ডেকে নিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পিটুনির সময় নিহত আবরারকে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালায় খুনিরা।
তবে আবরার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেছেন তার পরিবারের সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা।
হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ না রাখতে সিসিটিভি ফুটেজ মুছে (ডিলেট) দেয় খুনিরা। তবে পুলিশের আইসিটি বিশেষজ্ঞরা তা উদ্ধারে সক্ষম হন। পুলিশ ও চিকিৎসকরা আবরারকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পেয়েছেন।
এ ঘটনায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে তার বাবা চকবাজার থানায় সোমবার রাতে একটি হত্যা মামলা করেন। বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে। পাশাপাশি গঠন করেছে একটি তদন্ত কমিটিও।
এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় বুয়েট শাখার সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১১ জনকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন