ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট বিলাসী জীবনযাপন করলেও অবৈধ আয়ে সঞ্চয়ের পাহাড় কিংবা অঢেল সম্পত্তির সন্ধান পায়নি গোয়েন্দারা। এক্ষেত্রে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরীর ‘সম্রাটের সম্পদ বলতে কিছুই নেই' মন্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।
রাজকীয়ভাবে সঙ্গী-সাথী আর নিজের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেলা করলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসমাইল হোসেন সম্রাটের নামে বড় কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার মালিকানা বা অংশীদার নেই। তার ঘণিষ্ঠ যুবলীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, তিনি মোটেও বৈষয়িক ছিলেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যের চিন্তা কখনো করেননি। যা আয় করতেন তার সিংহভাগই নেতাকর্মীদের পেছনেই খরচ করতেন। সম্রাটের কাছে গিয়ে সহায়তা চেয়ে যুবলীগের কোনো নেতা বা কর্মী শূন্য হাতে ফিরেননি বলে দাবি করেছেন তারা। মাসে কোটি টাকা খরচ ছিল তার।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে দৃশ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকলে নিজ নামের যথার্থতা রক্ষা করে কি করে সম্রাটসুলভ জীবনযাপন করছিলেন। দেশে-বিদেশে নাকি কোটি কোটি টাকা তিনি উড়িয়েছেন। জন্মদিনের উপহার হিসেবে বিদেশি বান্ধবীকে বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন কীভাবে? দেশের বাইরে গেলে পাঁচতারা হোটেলে থাকার খরচ কীভাবে সামলাতেন সম্রাট? প্রশ্ন ওঠেছে, কেবল ক্যাসিনোর আয়ে কী এমন রাজকীয় জীবনযাপন করা সম্ভব। সম্রাটের ভক্ত-অনুরাগীদের দাবি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবের ক্যাসিনোর আয়ের সামান্য অংশই তার কাছে পৌছাতো। আর ওই টাকা নাকি অসচ্ছল নেতাকর্মী আর দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এ কারণে সম্রাটের নামে অজ্ঞান হাজার হাজার নেতাকর্মী।
ঢাকা শহরেই চাঁদাবাজি করে অনেক মাফিয়া ডন কোটি কোটি টাকা উপার্জনের একাধিক নজির গড়েছেন।সম্রাটের আয়ের অন্যতম উৎস যে চাঁদাবাজি, এটা মানতে রাজি নন তার সাঙ্গপাঙ্গরা।তারা বলছেন, নেতা সেলামি আর উপহার নিতেন। চাঁদায় জোরজবরদস্তি থাকে, কিন্তু সেলামি আর উপহারে মানুষ খুশি হয়ে দিয়ে থাকে।সম্রাটের সহচরদের বক্তব্য অনুযায়ী, মানুষের খুশি হয়ে দেওয়া সেলামি আর উপহারই ছিল সম্রাটের উপার্জনের প্রধান উৎস। এই উপার্জনের অংশবিশেষ আবার তিনি বিলিবন্টন করতেন। তার অবৈধ আয়ের খন্ডিত অংশ পেয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা, সংবাদকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ইসমাইল হোসেন সম্রাটের রাজনীতিতে উত্থান ও জীবনযাপন নিয়ে শোনা যায় নানা চমকপ্রদ কাহিনী।যখন যা চেয়েছেন, মুহূর্তে তা হাতের নাগালে চলে এসেছে। জীবনকে শতভা উপভোগ করেছেন তিনি। অথচ সম্রাটের শৈশব-কৈশোর এবং তারুণ্যের প্রথমভাগ কেটেছে অভাব অনটনে।বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (পিয়ন) ছিলেন। কাকরাইলে ছোট্ট খুপরি ঘরে বসবাস করতেন তারা। পরে চলে যান মালিবাগে। আর সম্রাট নিজের আয়ে প্রথম বাসা ভাড়া নেন বাড্ডাতে।
কথিত আছে, একসময় কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলকেন্দ্রিক কালোবাজারে সিনেমার টিকিট বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। কাকরাইলে সিনেমাপাড়ায় চলতে চলতে তৎকালীন মহানগর ছাত্রলীগ নেতা শহিদুল্লার সঙ্গে পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তিনি ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই কমিটির সভাপতি লুৎফর রহমানকে মারধরের অভিযোগে তাকে সংগঠন থেকেও বহিস্কার করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের দিকে তার হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। তখনও অনেকের কাছ থেকে ধারদেনা করে চিকিৎসার খরচ চালান তিনি। ওই সময় কুয়েতফেরত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয় তৎকালীন সরকার। পরে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ডেকে ডেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে সহায়তা করেন সম্রাট। সেই প্রথম তার হাতে আসতে থাকে কিছু 'কাঁচা টাকা'। তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের শেয়ারের একটি ছোট্ট অংশ কেনেন সম্রাট।
সম্রাটের রাজনৈতিক জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ২০০১ সাল। ওইবছর সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও আওয়ামী লীগের অন্য একজন প্রভাবশালী নেতার আশীর্বাদে রমনা থানা যুবলীগের আহ্বায়ক হন সম্রাট। ২০০৩ সালের সম্মেলনে মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে ২০১২ সালে দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হন তিনি। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মতিঝিল, ফকিরাপুল, আরামবাগসহ ঢাকার একটি বড় অংশে একক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন সম্রাট। মতিঝিল ক্লাবপাড়া পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন তিনি। ধারণা করা হয়, এসব নিয়ন্ত্রণ আর বিরোধের জের ধরে যুবলীগ নেতা মিল্ক্কীকে হত্যা করা হয়েছিল।
সম্রাটের চাঁদাবাজির সম্রাজ্য দিন দিন বড় হতে থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে কাউন্সিলর মমিনুল হক সাইদ, আরমান, স্বপন, সরোয়ার হোসেন মনা, মিজানুর রহমান বকুল, মোরছালিন, মাকসুদুর রহমানকে ব্যবহার করতেন তিনি। গণপূর্তের জি কে শামীমের ঠিকাদারি কাজ পেতে ভূমিকা রাখতেন সম্রাট। মৎস্য ভবনে সম্রাটের আস্থাভাজন হিসেবে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন বাবু ওরফে ক্যারেনসি বাবু। সব জায়গায় ঝামেলা পাকানোর কারণে বাবু ক্যারেনসি বাবু হিসেবে পরিচিত। সম্রাটের হয়ে আরও কয়েকটি দপ্তরে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন বকুল ও ইমদাদ। কথিত আছে, যুবলীগের একজন সহসভাপতি সম্রাটের হয়ে স্বর্ণ পাচারে সম্পৃক্ত। 'গ্লাসবয়' হিসেবে পরিচিত জাকিরের কাছে সম্রাটের কোটি কোটি টাকা রয়েছে। এ ছাড়া ফুলবাড়িয়া এলাকায় দুই ছাত্রলীগ নেতা আশপাশের বেশ কিছু মার্কেট ও অন্যান্য জায়গা থেকে চাঁদা তুলে সম্রাটের কাছে পৌঁছে দিতেন। মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের নেতা রবিউল ইসলাম সোহেলও সম্রাটের ক্যাসিনো পার্টনার। একজন সাবেক এমপির এপিএস সম্রাটের সঙ্গে ক্যাসিনো আসরে নিয়মিত যেতেন।
তৃণমূল যুবলীগের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, সংগঠনের কর্মসূচিতে হাজারো নেতাকর্মী হাজির করা যেমন একজন দক্ষ সংগঠকের কাজ, তেমনি ব্যক্তিজীবনে আদর্শবান হওয়া জরুরি। কারণ, নেতার আদর্শই তার শত শত কর্মী অনুকরণ করেন। তাই যে কোনো ভালো সংগঠকের পরিশীলিত চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে সম্রাট অনেক পিছিয়ে ছিলেন বলে মনে করেন যুবলীগের অনেক নেতাকর্মী।
কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে সম্রাট গড়েছিলেন তার আস্তানা। প্রথমে সেখানে তার একটি কক্ষ থাকলেও পরে পুরো ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। ওই জমির মালিক ছিলেন ওয়াজেদ আলী। পরে তার জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে মদিনা রিয়েল এস্টেট। এতে ৬৫ ভাগ পাওয়ার কথা ছিল রিয়েল এস্টেটের ও ৩৫ ভাগ জমির মালিকের। জমির মালিক ওয়াজেদ আলী তার মালিকানা বিক্রি করেন জনৈক ভূঁইয়ার কাছে। একসময় পুরো জমির মালিক ও রিয়েল এস্টেটকে বাদ দিয়ে পুরো ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেন সম্রাট। সেখানে বসেই তিনি চালাতেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। পুরো ভবনে ছিল একাধিক বিশ্রামাগার। সম্রাট ছাড়াও সেখানে যুবলীগের আরও একাধিক নেতার ব্যক্তিগত অফিস ছিল।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন