ঢাকার গাবতলী থেকে রওনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে তিন-চার ঘণ্টা লাগার কথা থাকলেও ঈদের আগে থেমে থেমে যানবাহন চলায় ১৮ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে যাত্রীদের। পুলিশ ও বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে পরিবহন নেতাদের যোগসাজশে ফিটনেসহীন ও লোকাল বাস চলতে দেওয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যাত্রার প্রায় শেষ পর্বে বিপত্তি ঘটে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত শুক্রবার রাত ১১টায় গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে হক এন্টারপ্রাইজের বাসে দিনাজপুরের পাবর্তীপুরের উদ্দেশে রওনা দেন হাবিবুর রহমান ফারুক। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী নাসরীন আক্তার ও দুই ছেলে আয়ান (১) ও আয়াত (৪)। পার্বতীপুর পৌর শহরের নতুন বাজারে শ্বশুরবাড়িতে যাবেন ফারুক। বাস দেরিতে ছাড়লেও ঈদ যাত্রার উচ্ছ্বাস ছিল তাঁদের মধ্যে। যাত্রা শুরুর পর ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে তাঁদের আনন্দের রং। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৪টায় তাঁদের বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতুতেই উঠতে পারেনি। যেখানে ঢাকা থেকে পার্বতীপুর যেতে আট ঘণ্টা লাগে, সেখানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ১৬ ঘণ্টায়ও পৌঁছা সম্ভব হয়নি। বিকেল সাড়ে ৫টায় ফারুক জানান, বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর ৩০ মিনিট ধরে বাস সামনে চলছে না। বাচ্চারা কান্না করে ঘুমিয়ে পড়েছে।
এই বাসের একাধিক যাত্রী জানায়, ভোরের আলো ফোটার পর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এসেছেন। কোনো জায়গায় টানা তিন ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়েছিল। মহাসড়কে যানজটে হকাররা যাই দিচ্ছিল তাই ছিল যাত্রীদের খাবার। একপর্যায়ে খাবারের পানিও শেষ হয়ে যায় ফারুকের। ছেলে আয়ান ও আয়াত গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে কখনো কাঁদছিল। তাদের নিয়ে বাস থেকে বের হওয়ারও অবস্থা ছিল না। ভোগান্তিতে পড়া যাত্রীরা সকাল পৌনে ১১টায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের রাবনা বাইপাসসহ বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর করে। যাত্রীরা বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহন থেকে বের হয়ে এ বিক্ষোভে অংশ নেয়।
মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বিক্ষোভের প্রত্যক্ষদর্শী নাট্য নির্মাতা জয়ন্ত রোজারিও বলেন, এখানে যানজটের বড় কারণ রাত থেকে সকালের মধ্যে ছোট ছোট গাড়ি ঢুকে লেনবিধি না মানা। মহাসড়কে মিরপুর লিংক, ছালছাবিল, তুরাগ, সুপ্রভাত, সেফটি, বলাকা, বনশ্রী-প্রভাতীর মতো ঢাকার নগর পরিবহনের বাসও ঢুকে পড়েছে। পুলিশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে রুট পারমিট না থাকার পরও এসব বাসে ঈদযাত্রীদের তোলা হয়েছে। এসব লোকাল বাস লেন মানছে না। পুলিশের লোকরা যানজট নিয়ন্ত্রণে ঠিকভাবে চেষ্টা করছে না। দুই মোটরসাইকেলচালক সামনে ব্যারিকেড থাকার পরও যেতে চাইলে ক্ষুব্ধ বাস যাত্রীরা তাদের মারধর করে। তারা লেন মানছিলেন না।
সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার ও মির্জাপুর থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার যানজট ছিল। সকাল ১১টা থেকে অতি ধীরে চলছিল গাড়ি। এই সেতুর পশ্চিম প্রান্তেও যানজট ছিল। সকাল ৭টা থেকে ৮টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল নেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল যানজট কমাতে।
টোল বন্ধ রেখেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল না : টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সঞ্চিত কুমার রায় গত রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, সিরাজগঞ্জ অংশে মহাসড়কের অবস্থা খারাপ। চালকরা গাড়ি টানতে পারছে না। কড্ডা মোড় থেকেও গাড়ি চলছে ধীরে। হাটিকুমরুল অংশে রেশনিং করতে হচ্ছে। ঈদ যাত্রার বহরে ফিটনেসহীন ও লোকাল বাস ঢুকে পড়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এখন চেক করতে গেলে যানজট বাড়বে। ঈদ যাত্রার আগে বলা হয়েছিল-এগুলো নামানো হবে না। সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টা বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল নেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল। তার পরও পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না। কারণ গাড়ির চাপ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি।
গতকাল সকাল ৭টায় গাবতলী থেকে যশোর যাওয়ার জন্য স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে সোহাগ এলিট পরিবহনের বাসে রওনা দেন আইনজীবী শামসুজ্জামান বাবু। বিকেল সোয়া ৪টায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাটুরিয়ায় ফেরিতেই উঠতে পারেননি তাঁরা। ঘাট থেকে এক কিলোমিটার দূরের সারি সারি বাসে ঈদযাত্রীরা ছিল অবরুদ্ধ। ফেরি ধীরে চলা ও একই সঙ্গে ভারী ট্রাক, বাস ছাড়াও ছোট গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় চাপ সামাল দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ফিরতি বাস ফিরতে দেরি হওয়ায় গাবতলী বাস টার্মিনালে আবার ১২ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। গ্রামীণ পরিবহনের বাসে নাটোর যাওয়ার যাত্রীরা হুড়মুড় করে উঠছিল গতকাল সকাল সোয়া ১১টায়। তাদের চোখমুখে ছিল ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। আগের রাত ১১টায় তাদের বাসে ওঠার কথা ছিল। তবে বাসে উঠলেও তাদের বাস আর চলছিল না। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভোগান্তি অপেক্ষাকৃত কম ছিল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন