স্বর্ণের ঔজ্জ্বল্যই তার আকর্ষণের বিষয়, অথচ পত্রিকায় পড়লাম সেই স্বর্ণ ‘সাদা’ করার জন্যে ‘মেলা’ হয়েছে; ভাগ্যিস আক্ষরিক অর্থে নয় – নইলে ভাবুন তো ৯৪ হাজার ভরি সোনা যদি সত্যি সাদা হয়ে যেত তা হলে কি কান্ডই না হতো? একে আমরা পি সি সরকারের যাদুমন্ত্র বলেই গণ্য করতাম। এই যে বিপুল পরিমান স্বর্ণ সেগুলো বৈধ পথে আসেনি, এখন এগুলো ‘বৈধ’ হলো । প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে, এগুলো হচ্ছে ‘চুনোপুঁটি’ ব্যবসায়ীদের হাতে থাকা স্বর্ণ। যারা এতদিন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সদস্য ছিলেন না তারাও তড়িঘড়ি করে সদস্য হয়েছেন, যাতে এই সুযোগ হেলায় না হারান। কিন্ত বড় ব্যবসায়ী যারা তারা অনেকেই এখনো নিজেদের মজুত স্বর্ণ সাদা করেননি। ফলে আসলে ‘সাদা নয়’ এমন স্বর্ণের পরিমাণ কত তার কোনও হদিস নেই।
এই স্বর্ণগুলো তো আকাশ থেকে পড়েনি, নিজেরাই হেঁটে এসে ব্যবসায়ীদের দরজায় কড়া নাড়েনি, কিংবা বাংলাদেশে সোনার খনি নেই যে এখান থেকে উত্তোলিত হয়েছে।। তা হলে আসলো কীভাবে? যারা আনলেন তাঁদের নিয়ে কারো কোনও আগ্রহ নেই। কেবল স্বর্ণ নয়, যারা আনলেন, যারা এই ব্যবসা করলেন তাঁদেরকেও সাদা করার ব্যবস্থাই হল – ঘোষনা দিয়ে, মেলা করে। শুধু কি তাই? আগামীতে যেন এই ব্যবস্থা চলতেই থাকে তার জন্যে ইতিবাচক ইঙ্গিত হচ্ছে এই ব্যবস্থা। স্বর্ণ সাদা হওয়া বিচিত্র শোনালেও তা কী খুব বিচিত্র বিষয়? বাজেটে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থাটি আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। আগেও ছিলো এখন তা আরো বেশি ‘বৈধ’ হয়েছে। তাতে কি ফল হবে সেটা অতীতের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। কিন্ত তাতে কার স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়না। ঐ যে ঋণ খেলাফীদের অর্থ মাফ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এর সঙ্গে স্বর্ণ বা কালো টাকা সাদা করার সম্পর্ক তো সহজেই বোঝা যায়, যায় না? আদালতের কারণে এখন খেলাফী ঋণ মাফ করার পদক্ষেপ আটকে গেছে। খেলাপী ঋণের ব্যাপারে হাইকোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে বলা হচ্ছে, গত ২০ বছরে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা; আদায়যোগ্য ঋণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, বিভিন্ন আদালতের আদেশে আটকে আছে ৮০ হাজার কোটি টাকা ও অবলোপন করা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ৭টি ব্যাংক ১ হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে। এই সবই ঘটছে প্রকাশ্যেই যখন বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত মজুরি কমছে। এই হিসেব আইএলও-এর। রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে আমাদের জানিয়েছেন, “২০১৫ ও ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রকৃত মজুরির প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২০০৮-১৭ সময়কালে বাংলাদেশের মানুষের গড় প্রকৃত মজুরির প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম (৩.৪ শতাংশ)। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার গড় হিসাব ৩.৭ শতাংশ। এই সময়কালে ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকার গড় প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৫.৫, ৪.৭ এবং ৪ শতাংশ ছিল।” একথাও আমাদের জানা আছে যে, বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে, জাতীয় আয়ে গরিব মানুষের অংশ কমেছে। পৃথিবীতে এক ধরণের হিরে পাওয়া যায় যেগুলোকে বলা হয় ‘ব্লাড ডায়মন্ড’। এগুলো হচ্ছে সেই ধরণের হীরা যা সংঘাতপূর্ণ এলাকার খনি থেকে উত্তোলিত হয়েছে এবং সেগুলো গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, ওয়ার লর্ডদের কার্যক্রম বা দখলদার বাহিনীর অর্থ যোগানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়। জেনে শুনে এখন কেউ এইসব হীরা কেনেন না। ‘সাদা’ স্বর্ণের খবর পড়ে ব্লাড ডায়মন্ডের কথা মনে হলো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন