ষাটের দশকের ছাত্রলীগের একজন নেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খানও স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর অনেক কর্মী-সংগঠকের মতো তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। এটা তার জন্য গৌরবের। কিন্তু জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিতর্কিত হঠকারী উগ্র রাজনীতির বিভ্রান্তির পথে ব্যর্থতার নজির সৃষ্টি করে এখন ইতিহাস বিকৃত করে তার জবানবন্দিতে ‘আমি সিরাজুল আলম খান’ বই লিখে অর্বাচীন বালকের পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে তিনি অতীতের ভুলের জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায়, সেখানে তার রাজনীতির নামে, ষড়যন্ত্রের জবাব না দিয়ে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নতুন নজির স্থাপন করে প্রমাণ করলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে তিনি এখনো মুক্ত হননি।
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অনেক অপচেষ্টা হয়েছে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকাে র মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্যুত করে খুনি চক্র ও সামরিক শাসকরা ইতিহাস বিকৃতিই করেননি, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মিথ্যাচারের জঘন্য নজির স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও লড়াইয়ে সামরিক শাসনের অবসানই ঘটেনি, স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে গণরায়ে উৎখাতই হয়নি, মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ সত্য ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতকারীরা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মসহ পৃথিবীব্যাপী আমাদের মহান স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার গৌরবের সঠিক ইতিহাস মীমাংসিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য ঘিরে ইতিহাসের মুখোমুখি হয়ে তার মতামত দেন।
আমির হোসেন আমু বলেন, একসময় বলা হতো, পৃথিবীতে ব্রিটিশের সূর্য অস্তমিত হয় না। ব্রিটিশের পরাধীনতা থেকে একে একে একেকটি দেশ তার জাতিসত্তা নিয়ে স্বাধীন হলেও ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম বা স্বাধীনতার সঙ্গে জাতিসত্তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। অর্থাৎ জাতিসত্তার ভিত্তিতে পাকিস্তান স্বাধীন হয়নি। ‘ইসলাম, মুসলমান, জিন্নাহ, পাকিস্তান’Ñ এই চার অনুভূতিতে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান জন্ম নেয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে মেনে নেননি। বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়ে তার বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে অভিজ্ঞতা আর আপসহীন সাহস নিয়ে ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও ’৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। আর কঠিন পরিস্থিতির মুখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ’৪৮ সালের ১১ মার্চ আন্দোলন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে কারাবরণ করেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপের আগে আমির হোসেন আমু জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাে র পর তারা যখন জেলখানায় তখন বিভিন্ন জাতীয় দিবসে রাজবন্দীরাও আলোচনা সভার আয়োজন করতেন। এমন এক আলোচনায় কমরেড মণি সিং বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রকে শুরুতেই মেনে নিতে পারেননি। তার সঙ্গে যখন আমার আলোচনা হতো তখন তিনি বলতেন, ‘দাদা সমাজতন্ত্র আপনারা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। তারচেয়ে আমাকে সমর্থন দিন। আমি দেশটা স্বাধীন করে আপনাদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দেব।’ বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছিলেন। দেশ স্বাধীন করে তিনি সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র রেখেছিলেন। এখন তাঁর হত্যাকাে র মধ্য দিয়ে দেশ কোন দিকে যাবে জানি না।’
আমির হোসেন আমু এরশাদ শাসনামলে ১৫ দলের বৈঠকে আওয়ামী লীগের অন্যতম সমন্বয়কারীই ছিলেন না, তখন রাজনীতিতে তাকে মিস্টার ডিসিশন বলা হতো। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা ছিল অন্যতম। সেই সময় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ কার্যালয়ে ১৫ দলের বৈঠক ছিল। বৈঠকের একপর্যায়ে বিরতিকালে প্রয়াত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাকে ন্যাপ সভাপতি মোজাফফরের কক্ষে নিয়ে যান। সেই সময় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আমির হোসেন আমুকে বলেছেন, “তোমাদের নেতা শেখ মুজিব কোনো দিন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমরা যখন গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করতে বসলাম তখন তিনি আমার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দেন। তাতে লেখা ছিল, ‘যারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবে এবং পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বিরোধিতা করবে তাদের কমিটিতে রাখা যাবে না’।”
আমির হোসেন আমু বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে পূর্ববাংলা ষড়যন্ত্রের শিকার হলো। দেশ ভাগ করে ব্রিটিশরা যখন চলে যাবে আলোচনা শুরু হলো। তখন ১৯৪০ সালে লাহোর বৈঠকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক অখ বাংলা নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিলে গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তীতে ’৪২ সালে আবার মুসলিম লীগ নেতারা এটা পরিবর্তন করেন। ’৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুতে ভোট হলে ৫টি প্রদেশের ৪টি পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, ফ্রন্টইয়ার, সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম লীগ হেরে যায়। একমাত্র বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। আর অন্যখানে অন্যরা সরকার গঠন করে। বাংলা ভাগ করে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রেস কনফারেন্স করে বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে পূর্ব পাকিস্তানের অংশকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করল। আর পাকিস্তানিরা তাদের সেই ষড়যন্ত্র থেকে বুঝতে পারল সোহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রী থাকলে আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তাই পরে তারা তাকে বাদ দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দিল।
আমির হোসেন আমু বলেন, সেই সময়ের পরিস্থিতি আজকে বসে ভাবলে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে তখন তারচেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। ইসলাম, পাকিস্তান, জিন্নাহ, মুসলমান তখন একাকার। এ অবস্থায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে দেওয়া দুঃসাহসিক লড়াই ছিল, যা সাদামাটাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অনেকে মনে করতে পারেন, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ খুব সহজেই স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আসার সংগ্রাম যে কতটা কঠিন ছিল তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মেনে না নিয়ে যে লড়াই শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি কেবল বুঝেছেন। তিনি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে যে সূচনা করেছিলেন, পরবর্তীতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর লড়াই জনগণের মধ্যে সেই চেতনার বারুদ জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল অসাধ্য সাধন। সেটি তিনি করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুভাষী ছিলেন। তখন ঢাকা বলতে ছিল পুরান ঢাকা। যাদের বলা হয় কুট্টি। তাদের ভাষাও ছিল উর্দু। পাকিস্তানের প্রতি ছিল তাদের কঠিন আনুগত্য। কিন্তু অসম্ভব রকমের দূরদর্শী বিচক্ষণ ও কৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান ’৪৮ সালের ১১ মার্চ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে রাজপথে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সারা দেশের জনগণের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। সেই মিছিলে লাঠিচার্জ হলো এবং তিনি গ্রেফতার হলেন। ’৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এলে বর্তমান বঙ্গভবন তৎকালীন গভর্নর হাউসে উঠলেন। সেদিন মওলানা ভাসানীকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দিলেন। নগর ঘুরে গভর্নর হাউসের কাছে গেলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং সেখান থেকে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হক গ্রেফতার হলেন। ’৫২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ছাড়া বাকিদের পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি দেন। এক. ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাবেশ ও মিছিল। তার পরদিন আরবি হরফে বাংলা খেলা যাবে না এই দাবিতে প্রতিবাদ সভা এবং তার পরদিন শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে মিছিল সমাবেশ। শেখ মুজিবের এই তৎপরতার কারণে তাকে ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তিনি জানিয়ে দেন, ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে অনশন করবেন, বাইরে যেন সবাই আন্দোলন চালিয়ে যান। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ছাত্র মিছিলে গুলি ও হত্যাকা ঘটালে বাকি দুই দিনের কর্মসূচি তলিয়ে যায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলন ঘিরে দেশের জনগণের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে যায়।
সেদিন ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর কারাগারে মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে অনশন করেন। সেই ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় জনগণের হৃদয়কে আন্দোলিত করার বড় বিজয়। এর ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে তার লক্ষ্যে অগ্রসর হলেন। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের বাস্তবতায় কৌশল হিসেবে সেই ‘ইসলাম, মুসলমান, পাকিস্তান ও জিন্নাহ’র অনুভূতিতে সাম্প্রদায়িক আবেগ-অনুভূতি থেকে জনগণকে বাঙালির অধিকার আদায়ের পথে বের করে আনতে দুটি সংগঠনই মুসলিম শব্দটি যোগ করেছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। শামসুল হকের মাথায়ও টুপি ছিল। তাদেরই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল এই ধারণা দিতে যে, আমরা ধর্ম ও পাকিস্তানবিরোধী নই, বাঙালির অধিকার চাই। এটি ছিল রাজনৈতিক কৌশল। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় যে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিতেন এবং যেসব আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন সেখানে কমিউনিস্টপন্থি ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সমন্বয় করতেন।
সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে বিহারেও গিয়েছিলেন টিম নিয়ে রায়ট ঠেকাতে। আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার প্রমাণ মেলে সেই সময় টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা খুররাম খান পন্নী যখন আওয়ামী লীগের শামসুল হকের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করেন। ওই পরাজয়ের কারণে চতুরতার আশ্রয় নিয়ে ৫০টির বেশি আসনের উপনির্বাচন আর মুসলিম লীগ সরকার দেয়নি। আমির হোসেন আমু আরও বলেন, ’৫৬ সালে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের মতবিরোধ শুরু হয়ে যায় আবু হোসেন সরকারের পতন ঘটলে। তখন চারদিকে কলেরার মহামারী ও দুর্ভিক্ষে মানুষের অবস্থা করুণ। ভাসানী বললেন, ‘এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণ করতে না পারায় জনপ্রিয়তা হারাবে।’ সোহরাওয়াদী বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের দায়িত্ব নেওয়া। আমরা যাদি ৫টি লোককেও বাঁচাতে পারি তাহলে মনে করব কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করেছি।’ শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ যখন সৃষ্টি হয় তখন ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন করা সম্ভব ছিল না। তখন তাদের চিন্তার অনেকেই আওয়ামী লীগে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ’৫২-র ভাষা আন্দোলন আর ’৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়ের পর পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যায়। অলি আহাদের মতো যারা শেখ মুজিববিরোধী ষড়যন্ত্রে সিদ্ধহস্ত তারা সুযোগ নিয়ে মওলানা ভাসানীকে ভর করলেন। ’৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বামদের নিয়ে ন্যাপ গঠন করে দলে ভাঙন আনেন। আমির হোসেন আমুর ভাষায়, তখন আওয়ামী লীগের সামনে শেখ মুজিব ছাড়া কোনো নেতা নেই। তখন তিনি সভাপতি হতে পারতেন। কিন্তু তখনো তিনি সভাপতি না হয়ে তার বিচক্ষণতায় কৌশলের পথ নিলেন। ভাসানীর জায়গায় আওয়ামী লীগের সভাপতি করলেন আরেক মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশকে। তিনি আবার হন সাধারণ সম্পাদক। এর আগে ’৫৩ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে মুসলিম লীগ হটাতে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে গণতন্ত্রী দল, নেজামী ইসলাম, খেলাফতে রব্বানী, কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের আলোচনা হয়। ১১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিলে যে ২১ দফা গৃহীত হয় সেটাই পরে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার হয়। ’৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ২৩৭টি আসনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি, মুসলিম লীগ ৯টি ও স্বতন্ত্র ৫টি আসনে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে সংখ্যালঘু আসনে ২৫টিতে জাতীয় কংগ্রেস ২৭টিতে কাস্ট ফেডারেশন ও ১৩টিতে সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট। ’৫৪ সালের নির্বাচনের পর ’৫৫ সালের রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দল থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দলের চরিত্র উন্মোচিত করা হয়। অন্যদিকে যুক্ত নির্বাচনের দাবি তোলা হয়, যা ’৫৫ সালে ব্যাপক আকার নেয়।
আমির হোসেন আমু বলেন, সেই সময় ঢাকা থেকে স্টিমার সন্ধ্যায় ছাড়ত। বরিশালে সকাল ৮টায় পৌঁছত। আর বরিশাল থেকে খুলনার উদ্দেশে ৫টায় ছাড়ত। বঙ্গবন্ধু ’৬১ সালের শেষের দিকে বরিশাল গিয়ে নেতাদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন এবং তাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে তার বোনের বাড়িতে চা-নাস্তা করতে যান। আমির হোসেন আমু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন রিকশায়। শেখ মুজিব বললেন, ‘তৈরি হয়ে যা। এবার যে আন্দোলন করব তা হবে মূল আন্দোলন, খালি খালি জেল খাটার আন্দোলন নয়।’ বঙ্গবন্ধুকে সেবারের মতো বিদায় দিয়ে তিনি সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। দেড় মাস পর শেখ ফজলুল হক মণি চিঠি লিখে তাকে জানালেন, ‘ঢাকায় চলে আসো। মামা (শেখ মুজিব) কথা বলতে চান।’ আমু তার বন্ধু ও ছাত্রলীগ কর্মী বারেককে নিয়ে ঢাকায় এসে তার খালার বাসায় উঠে খাওয়া-দাওয়া সেরে শেখ ফজলুল হক মণির আরামবাগের বাসায় গেলেন। সাক্ষাতে কুশল বিনিময় ছাড়া শেখ মণি কিছু বললেন না। সেখান থেকে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শোন, তোর ওখানে নাকি ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়ন গোলমাল করে। তুই এটা মিটিয়ে ফেল। সংগ্রাম পরিষদ করতে হবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবিতে এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করবেন। শেখ মণি তোকে বিস্তারিত বলবে এবং ফরহাদের (মোহাম্মদ ফরহাদ তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও পরে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক) সঙ্গে বসবে। কীভাবে কী করতে হবে সব বলবে। এটা হবে মূল আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম। মণি দুপুরে তোকে একটি জিনিস দেবে।’ শেখ ফজলুল হক মণি এমএম হলে নিয়ে আমির হোসেন আমুকে একটি প্যাকেট দিলেন। বললেন, ‘এটা বরিশালে নিয়ে খুলবে। এখন খুলতে হবে না। বুঝে বুঝে মানুষজনদের দেবে।’ আমির হোসেন আমু বলেছেন, বরিশাল এসে তিনি খুলে দেখেন বিএলএফের লিফলেট। যেটির কথা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও বলেছেন। এটি দেখে তিনি নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে যান। দুই দিন পর আবার খবর। খবর ঢাকায় যাওয়ার। বঙ্গবন্ধু বললেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হবেন। গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে ......চলবে
(সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন