মহাখালীর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পেছনের গলি, শিক্ষার্থীদের কোলাহল আর আড্ডায় মুখর চায়ের দোকানগুলো। ক্লাসের ফাঁকে এসব দোকানে বসে গল্প, হাসিঠাট্টা আর পড়াশোনা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা।
পড়ন্ত দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অসংখ্য তরুণ-তরুণীর ভিড়ে হঠাৎই দেখা গেল ব্যাগ কাঁধে একদল কিশোরকে। তাদের সবারই বয়স আনুমানিক ১৩ থেকে ১৫ বছর। সবাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গলি দিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে।
তাদের মধ্যে এক কিশোর উঁচু গলায় আরেকজনকে বলছে ‘আজ তোকে আমার হাতে মরতে হবে, কেউ বাঁচাতে পারবেনা’।
জবাবে আরেকজন বলছে- ‘যা ব্যাটা আমার কাছে যেসব অস্ত্রের কালেকশন আছে, তোরে বুঝায়ে দিমু।’
এই কিশোরদের আলোচনা শুনে যে কেউ মনে করবে বড় ধরনের গ্যাং ওয়ারের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
তবে, তাদের অনুসরণ করার পরই বোঝা গেল আসল ঘটনাটা কী! সব কয়জন কিশোরই প্রবেশ করলো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের গলির ইজাব ফ্লোরা ইউনিটি টাওয়ারে। লিফটের পাশের সিঁড়ি বেয়ে তারা উঠে গেল প্রথম তলায়।
সেখানে গিয়ে দেখা গেল অরোরাল টেক লিমিটেডের একটি শো-রুম, যেখানে গেমিং কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বিক্রি করা হয়। শো-রুমটির পাশেই কাঁচ ঘেরা একটি বড় জায়গা। ভেতরে সারিবদ্ধভাবে সব গেমিং কম্পিউটার সচল অবস্থায় রাখা। কিশোরদল হই-হুল্লোড় করতে করতে ভেতরে ঢুকে কম্পিউটারগুলো দখল করলো। এরপর তাদের বেশিরভাগই খেলতে শুরু করলো অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার ব্যাটল রয়্যাল গেমস পিইউবিজি বা পাবজি।
আবার কাউকে খেলতে দেখা গেল ওয়ারফেস নামের আরেকটি গেমস। এই দুটিই খুনোখুনি ও হিংস্র লড়াইয়ের গেমস।
মহাখালীর এই গেমিং জোনের মতো রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যেই বাচ্চাদের এসব গেমস খেলার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। কিশোর তরুণদের মধ্যে ভয়ঙ্কর নেশায় পরিণত হয়েছে পাবজি ও ওয়ারফেসের মতো গেমস।
খেলাগুলো দীর্ঘ মিশন সম্পন্ন হওয়ায় এর লক্ষ্যসন্ধান পূর্ণ করতে যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে, তেমনি প্লেয়ারদের (কিশোর ও তরুণ সমাজ) মানসিক চাপের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অরোরাল গেমিং জোনের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেল দায়িত্বরত ম্যানেজার নিজেই বুদ হয়ে আছেন পাবজি গেমের নেশায়। কথা বলার সময় নেই তার। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বলে উঠলেন ‘ভাই কি গেমস খেলবেন? জবাবে ‘না, দেখতে এসেছি’, বললে তিনি বলেন- ‘ওহ, আচ্ছা দেখেন।’
ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তার নাম মো. ইব্রাহীম। তিনি জানালেন, এখানে গেমস খেলার সিস্টেম ঘণ্টা হিসেবে। প্রতি ঘণ্টা ৭০ টাকা করে নেয়া হয় গ্রাহকদের কাছ থেকে। পাবজি-ওয়ারফেজ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গেমস রয়েছে। এখানে তবে শিশু-কিশোররা এই দুইটি গেমসই বেশি খেলে।
ইব্রাহীম জানান, শিশু-কিশোররা এসে গেমস খেলা শুরু করলে কেউ ঘণ্টা তিনেকের আগে উঠতে চায় না। পাবজিটাই তাদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া অনেকে ওয়ারফেস গেমসও খেলে।
সাদ্দাম নামের এক কিশোর বলেন, পাবজি গেমসটা আমার খুব পছন্দের। আমি প্রায় প্রতিদিনই এখানে এসে দুই ঘণ্টা করে গেমস খেলি। প্রাইভেট আর স্কুলের ফাঁকে সময় পেলেই এখানে এসে গেমস খেলি।
বাসায় কি জানে তুমি প্রতিদিন এখানে গেমস খেলতে আসো, এমন প্রশ্ন করা হলে ওই কিশোর বলে, হ্যাঁ বাসায় জানে যে খেলতে আসি মাঝে মধ্যে। কিন্তু প্রতিদিন আসি এটা জানলে খুব বকাঝকা করবে মা। আগে ফুটবল-ক্রিকেট এগুলো খেলতে খুব ভাল লাগতো। কিন্তু এই গেমস যখন খেলা শুরু করলাম তারপর থেকে আর অন্য কোনো গেমস ভাল লাগে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু মহাখালীর ইজাব-ফ্লোরা ইউনিটি টাওয়ারই নয়, রাজধানীর গুলশান-২ এর রব ভবনের তৃতীয় তলায়ও অরোরাল গেমিং জোনের ব্রাঞ্চ রয়েছে। এছাড়া নামে বেনামে রাজধানীর গুলশান, মগবাজার, বনানী, মহাখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গেমিং জোন।
শুধু যে গেমিং জোনে গিয়েই কিশোর-তরুণরা এই গেমসগুলো খেলছে, তা কিন্তু নয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা স্মার্টফোনেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুদ হয়ে থাকছে এসব গেমসে।
মাঝে মধ্যে চায়ের দোকান বা অলিতে গলিতে দেখা যায় কিশোর ও তরুণরা দলবেঁধে বসে আছে, সবার চোখ যার যার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। আসলে তারা সবাই একে অপরের সাথে অনলাইনে পাবজি, ওয়ারফেস অথবা ক্ল্যাস অব ক্ল্যানসের মতো ভয়ঙ্কর হানাহানীর গেমস খেলতে ব্যস্ত।
সম্প্রতি টানা ছয় ঘণ্টা পাবজি খেলে ভারতের রাজস্থানের নাসিরবাদ শহরের ১৬ বছরের এক কিশোরের মৃত্যুতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ওই ঘটনায় এই গেমসটি বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে প্রতিবেশী এই দেশ। এছাড়া নেপালেও সম্প্রতি পাবজি গেমসটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
পাবজি, ওয়ারফেজের মতো গেমের নেশার তীব্রতায় বিভিন্ন সময় ঘটেছে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা। এগুলো খেলে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছে কেউ কেউ।
রাইসুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমার ছেলে দীর্ঘদিন ধরে পাবজি গেমস নিয়ে পড়ে থাকে। অনেক মেধাবী ছিল, কিন্তু এই গেমস শুরু করার পর থেকে সারাক্ষণ এটার ভেতরেই ডুবে থাকে। কিছু বলা যায় না, বকাঝকা করলেই রাগ দেখায়। কোনো ভাবেই এই নেশা থেকে ওকে বের করতে পারছি না। এসব গেমস খেলে বাচ্চাদের ব্যবহার ও আচরণে উগ্রতা দেখা দিচ্ছে। সরকারের উচিত এসব গেমস বন্ধে জোরালো ভূমিকা নেয়া।
নাসরিন সুলতানা নামে আরেক অভিভাবক বলেন, এসব গেমসের ছলে বাচ্চাদের রক্তপাত, মারামারি, হানাহানী এসবে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে। মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধ্বংসাত্মক মনোভাবকে টেনে বের করে আনছে এসব গেমস। শিশুদের মাঝে আক্রমণাত্মক প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের আচার আচরণেও। তাই এগুলো বন্ধে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের ডিসি আলিমুজ্জামান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় পাবজি-ওয়ারফেসের মতো গেমসগুলোর বিরুদ্ধে সচেতন অভিভাবকদের অভিযোগ পেয়েছি। আমাদের ফেসবুক পেইজেও অনেকেই এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। আমদের এক্সপার্টরা এসব গেমস পর্যালোচনা করে দেখছেন। সব কিছু পর্যালোচনার পরই দ্রুত আমরা এসব গেমসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মেধা-মনন ঠিক রাখতে যা করণীয়, তাই করবো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন