অপহৃত হওয়ার এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হলেও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম ওরফে সৌরভের কোনো সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তার পরিবারের দাবি, সৌরভকে অপহরণের সময়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ রয়েছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশপ্রধানকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো অপহরণকারীরা ধরা না পড়ায় সৌরভের প্রাণশঙ্কায় ভুগছেন তারা।
এদিকে ভাগ্নের সন্ধান চেয়ে গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন সোহেল তাজ। রাজধানীর সেগুনবাগিচার ডিআরইউর সাগর-রুনি মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলনে সোহেল তাজ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সৌরভের মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমান ও বাবা সৈয়দ মো. ইদ্রিস আলম।
এ সময় এ অপহরণের ঘটনায় র্যাবের হাত থাকতে পারে বলে ধারণা পোষণ করে দীর্ঘ বক্তব্য দেন সৌরভের মা। ছেলেকে ফিরে পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সোহেল তাজের মামাতো বোনের ছেলে সৌরভ। ঢাকার ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করে ব্র্যাকের একটি ডকুমেন্টারি নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে ‘বেঙ্গলি বিউটি’ নামে একটি সিনেমাও তৈরি করেন সৌরভ।
গত ৯ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানার প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার আগোরা সুপারশপের সামনে থেকে তিনি অপহৃত হন। বিষয়টি জানিয়ে ঘটনার পরদিন সৌরভের বাবা ইদ্রিস আলম পাঁচলাইশ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এ ছাড়া গত শনিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে সৌরভকে অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সৌরভের মা ইয়াসমিন আরজুমান জানান, ২০১৭ সালে সৌরভের তৈরি সিনেমা ‘বেঙ্গলি বিউটি’ দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করে। সে সময় সওদা নামে এক মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় ও যোগাযোগ শুরু হয়। পর্দানশীন পরিবারের মেয়ে সওদা মোবাইল ফোনেই সৌরভকে বিয়ের প্রস্তাব এবং তাতে রাজি না হলে আত্মহননের হুমকি দেয়। এর মধ্যেই ওই মেয়ের অমতে পরিবার সওদাকে অন্যত্র বিয়ে দেয়। তবে সে বিয়ে ২০১৮ সালে ভেঙে যায়। এর পর থেকে সওদার বাবা ঢাকার ব্যবসায়ী আজাদ চৌধুরী আমার ছেলেকে দোষারোপ করা শুরু করেন। তিনি আমার ছেলেকে ও আমাদের প্রাণনাশের হুমকি দেন। এর জেরে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সৌরভকে উত্তরা র্যাব সদর দপ্তরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। মোবাইল ফোনের সব ডাটা ডিলেট করে সেখানেও সওদার ব্যাপারে তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
সৌরভের মা আরও জানান, গত ১২ ফেব্রুয়ারি বনানী থানার ওসি সৌরভকে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। এক সপ্তাহ পর এনএসআইয়ের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে এক রেস্টুরেন্টে সৌরভের বৈঠক হয়। সেখানে তারা সৌরভের কাছে সওদার ব্যাপারে জানতে চান। পরে তারা প্রাপ্ত তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানোর কথা বলে চলে যান।
এর আগে ২০১৮ সালের ১৬ মে বনানীতে এক বন্ধুর বাসা থেকে ডিজিএফআই ও র্যাব পরিচয়ে একদল লোক সৌরভকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারা সৌরভকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আটকে রাখে। পরের দিন রাত পৌনে ১২টায় একই কায়দায় তাকে ফেরত দিয়ে যায়। এ দীর্ঘ সময় তারা সৌরভকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সওদা সংক্রান্তে।
ইয়াসমিন আরজুমান বলেন, র্যাব জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সৌরভকে চাকরির প্রলোভন দেখায়, কাগজপত্র চায়। এর পর গত ৮ জুন দুপুরে র্যাব ফোন করে তাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে বলে। এর পর বেলা ৩টার দিকে সৌরভকে চট্টগ্রাম আফমি সুপার মার্কেটের আগোরার সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয়। যার মামা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, তার ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটনা ঘটেÑ তা হলে অন্য সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে কী হতে পারে?
একই প্রশ্ন রেখে সোহেল তাজ বলেন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। কোনোভাবেই এ অবস্থা আমরা আশা করতে পারি না; কোনো নাগরিক গুম কিংবা অপহৃত হোক। কার কী পরিচয় তা মুখ্য বিষয় নয়। এ ধরনের ঘটনা কারও জন্য কাম্য নয়। আমরা আশা করব না অন্য কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রে এমন কিছু হোক। আজকে আমার ভাগ্নে, কালকে হয়তো আপনার ভাই হতে পারে। আরেক দিন হয়তো আপনার সন্তান হতে পারে। এটা আমাদের কারও কাম্য নয়। এখানে আইনের শাসনে রাষ্ট্র চলবে। ন্যায়বিচার সুবিচারের রাষ্ট্রে এ রকমটা হওয়া বা এমন পরিণতির শিকার হওয়া কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। আশা করছি, ভাগ্নে সৌরভকে ফিরে পাব।
ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে অপহরণকারীদের পরিচয় প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নে সোহেল তাজ বলেন, আমাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকাল পুলিশ যোগাযোগ করছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্মকর্তার নম্বর থেকে কল গেছে সৌরভের ফোনে। সেটা আমরা জানতে পেরেছি। এ অবস্থায় আমাদের একটাই লক্ষ্য, ভাগ্নেকে ফিরে পাওয়া।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সৌরভকে অপহরণের দৃশ্য
সৌরভের বড় ভাই তানভির শাহরিয়ার সম্রাট জানান, একটি আইটি কোম্পানিতে নিয়োগ হয়েছে-এমন ফোন পেয়ে সেখানে যোগ দিতে গত ৯ জুন চট্টগ্রাম গিয়েছিল সৌরভ। চাচাতো ভাই সাহেদুর মোটরসাইকেলে করে সৌরভকে পাঁচলাইশ থানার প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। পরে আফমি প্লাজার আগোরা সুপারশপের সামনে থেকে কালো রঙের একটি প্রাডো গাড়িতে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আগোরা সুপারশপের সিসি ক্যামেরার ওই দিনের ফুটেজে দেখা গেছে, একটি ফোনকল রিসিভ করে আফমি প্লাজার পেছনে যান সৌরভ। সেখান থেকেই পাঁচ ব্যক্তি কালো প্রাডোতে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় সৌরভের হাতে একটি সাদা খামে তার সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) ছিল। আফমি প্লাজার সামনে নামিয়ে দেওয়ার সময় সৌরভ সাহেদুরকে জানিয়েছিলেন, ১০/১৫ মিনিট পর আবার ফোন করবে সে, তখন এসে যেন তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু ১৫ মিনিট পর ফোন করলেও সৌরভের মোবাইল ফোন বন্ধ পান সাহেদুর।
সৌরভের বাবা ইদ্রিস আলম জানান, সৌরভকে যে কালো রঙের প্রাডোতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই গাড়িটি বের করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু অপহরণের আট দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ ওই গাড়ি বা সৌরভের অবস্থানই শনাক্ত করতে পারেনি। সৌরভকে উদ্ধারে তিনিও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাসেম ভূঁইয়া জানান, সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত সৌরভকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কারা তাকে অপহরণ করেছে তা এখনো জানা যায়নি। যে মোবাইল ফোন নম্বর থেকে সৌরভকে ডেকে চট্টগ্রাম আনা হয়েছিল, সেই ফোন নম্বরও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সৌরভকে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন