যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক দশকে পাচারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। আমদানি-রফতানির সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এ অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিএফআইয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে দেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তুলনায় পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ। একই বছরে অবৈধভাবে দেশে এসেছে ২৮০ কোটি ডলার বা প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই পাচার হয়েছে নানা কৌশলে। জিএফআইয়ের হিসাবে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, তাদের দেয়া অর্থ পাচারের সব হিসাবই রক্ষণশীল, অর্থ পাচারের প্রকৃত পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে। এর সত্যতা খুবই সহজ। কারণ জিএফআই শুধু প্রাতিষ্ঠানিক আমদানি-রফতানির লেনদেন থেকে পাচারকৃত অর্থের হিসাব দিয়েছে, বিত্তশালী ব্যক্তি, শিক্ষার্থী, রোগী, পর্যটক, অভিভাবক, মা-বাবা—এদের দ্বারা হুন্ডি বা অন্যান্য অবৈধ উপায়ে পাচারকৃত অর্থের হিসাব দেয়নি। সুতরাং সব মিলিয়ে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরো বেশি হবে।
জিএফআই ১৪৮টি দেশের অর্থ পাচারের প্রতিবেদন দিয়েছে। এ ১৪৮টি দেশের মোট পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৫৯ হাজার ৯২২ কোটি ডলার, যা টাকার অংকে ৫০ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪৮ কোটি দাঁড়ায়। তার মধ্যে প্রথম স্থানে থাকা চীন থেকে ২২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার, দ্বিতীয় স্থানে থাকা মেক্সিকো থেকে ৪ হাজার ২৯২ কোটি ডলার, তৃতীয় স্থানে থাকা মালয়েশিয়া থেকে ৩ হাজার ৩৩৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। ১ হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে এমন দেশের তালিকায় আছে রাশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়া। ভারত থেকে পাচার হয়েছে ৯৭৯ কোটি ডলার (প্রথম আলো ২৯-০১-২০১৯)। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখান থেকে অর্থ পাচার হয় না কিংবা যে দেশে অবৈধভাবে অর্থ প্রবেশ করে না। উন্নত দেশগুলোয় যেখানে উন্মুক্ত মুদ্রাবিনিময় ব্যবস্থা প্রচলিত এবং যেখানে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান, সেসব দেশ তাদের মুদ্রা পাচার বা অবৈধভাবে মুদ্রা প্রবেশ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কারণ তাদের অর্থনীতির আকার, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, জীবনযাত্রার মান, নিরাপত্তা এমন সুদৃঢ় যে মুদ্রা পাচার অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলে না। সেসব দেশে পাচার হওয়া অর্থ আবার ফিরে আসে। কিন্তু উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য যেখানে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার, সেসব দেশের মুদ্রা পাচার হলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বাংলাদেশ এসব দেশের অন্যতম একটি।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ২০১২ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ এবং ২০১৪ সালে ৭০০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। এছাড়া ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, শিল্পের যন্ত্রপাতি-ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। এতে শিল্পের কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। এছাড়া বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে। অর্থাৎ পাচারকারীরা পুরনো, নতুন, আধুনিক ইত্যাদি বহু রাস্তা অর্থ পাচারে ব্যবহার করেন, যা ধরা পড়ে না। হুন্ডি ব্যবস্থা তো আছেই।
পাচার হওয়ার কারণগুলো
১. কেউ কউ স্বভাবজাত কারণে বা বন্ধুবান্ধবকে অনুসরণ করে বিদেশে বিলাস জীবনযাপনের জন্য কিংবা অবসর জীবন কাটাতে অর্থ পাচার করেন।
২. যখন মানুষ সরকারের স্থায়িত্ব কিংবা দেশের শাসন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আশঙ্কা করে, তখন নিজের বৈধ অর্থের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য অর্থ পাচার করে।
৩. কেউ কেউ জমে যাওয়া অবৈধ অর্থের বিশাল অংক লুকানোর জন্য বিদেশে বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা কেনার জন্য অর্থ পাচার করেন।
৪. কেউ কেউ ছুটি বা অবসর কাটানোর জন্য বা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বিদেশে তাদের স্থায়ী বসতি গড়ে দেয়া এবং স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করার জন্য টাকা পাচার করেন। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিংবা কানাডায় বেগমপাড়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৫. ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নিজেদের উদ্বৃত্ত মূলধন দেশে বিনিয়োগ করতে না পেরে অর্থাৎ বিনিয়োগের উপযুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ না পেয়ে বিদেশে কলকারখানা বা ব্যবসা কিনতে পাচার করেন।
৬. দেশে উপযুক্ত শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা না পেয়ে, জীবনযাপনের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না পেয়ে কিংবা সুশাসনের অভাবে জীবনের নিরাপত্তা না পেয়ে অনেকে বিদেশে নিজের বা সন্তানদের বসবাসের জন্য অর্থ পাচার করেন।
৭. রাজনৈতিক কারণে জীবনের হুমকি এড়াতে এবং বিদেশে আশ্রয় লাভের জন্য কেউ কেউ টাকা পাচার করেন।
৮. বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা দেশে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রি করে অর্জিত অর্থ নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ করতে পাচার করেন।
উল্লিখিত কারণগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, আরো বহু দেশে বিরাজমান। অর্থ পাচারের আরো বহু কারণ থাকতে পারে। কিন্তু অর্থ পাচার রোধের আইনানুগ প্রতিষেধক বা উপায়গুলো কার্যকর করা কঠিন। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কমে যাওয়ার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে অর্থ পাচার। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ে। অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নাগরিক জীবনে মৌলিক অধিকার, যেমন গুণগত শিক্ষা, নিরাপদ খাদ্য, সুলভে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
আইন প্রয়োগ করে অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা যত কঠিন হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নাগরিক জীবনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত এবং রাষ্ট্রে একটি নিরাপদ ও সুন্দর জীবনযাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করে অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা তত সহজ হবে। আইন প্রয়োগ করে মানি লন্ডারিং বন্ধ করার জন্য ব্যাংকে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু কাযর্ক্রমগুলো দেশের অভ্যন্তরে ভালো সফলতা এনে দিলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাচার রোধে তেমন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে যেসব আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন রয়েছে, তা প্রয়োগ করা হচ্ছে না। হলেও কার্যত ফল দিচ্ছে না। বাংলাদেশ ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছে। পৃথিবীর ১৫৯টি দেশ এ প্রতিষ্ঠানের সদস্য। বাংলাদেশ এর সদস্য হওয়ায় অর্থ পাচার-সংক্রান্ত যেকোনো আন্তর্জাতিক তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। তাহলে এতদিন বাংলাদেশ কী করল? অর্থ পাচার তো দিন দিন বেড়েই চলছে! গত বছর পানামা ও প্যারাডাইস পেপারে অর্থ পাচারকারী বাংলাদেশী ৮২ জন ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এ-যাবৎ অনুসন্ধান করে কারো বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।
সুতরাং অর্থ পাচার রোধ করে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশীদের উদ্বৃত্ত মূলধন দেশের ভেতরেই বিনিয়োগ করার সুযোগ দিতে হবে। এজন্য সর্বপ্রথমেই জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুশাসন। একজনের দুর্নীতি দেখে অন্যজন উৎসাহিত হয়। খারাপ নাগরিক সুনাগরিককে খারাপ বানায়। সুশাসন থাকলে সময়মতো অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হলে অপরাধ কমে যাবে। তাই আবার বলছি, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সুশাসন দরকার।
আলী ইদরিস
লেখক: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন