জাপান কোম্পানীর নির্মাণাধীন ‘কাঁচপুর, গোমতী ও মেঘনা ২য় সেতু’ নিয়ে গত কয়েকদিনেই একটি খবর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। খবরটিতে বলা হচ্ছে, ‘সেতু তিনটির জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। কিন্তু খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। অর্থ্যাৎ বাকি থাকা ৫০০ কোটি টাকার মত ফেরত দিচ্ছে জাপানিজ কোম্পানী। এটাই জাতি হিসেবে জাপানিজদের সততা।’ আসলেই কি প্রকল্পের টাকা বেঁচেছে এবং তা বাংলাদেশকে ফেরত দিচ্ছে? কিংবা প্রকল্পের টাকা বাঁচার কারণই বা কী?
খোঁজে জানা গেছে, সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) অনুযায়ী দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় মেঘনা ও গোমতী সেতুর কাজ শেষ হবে। বাস্তবে কাজ শেষ হলো তারও প্রায় সাত মাস আগে।
তথ্যমতে, সাত মাস আগে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় প্রকল্পে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। এখানে জাপানীজ কোম্পানীগুলো টাকা ফেরত দিচ্ছেন- বিষয়টি এমন নয় বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো বড় প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হলো। এটা মাইলফলক হিসেবে থাকবে।
প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুজ্জামান জানান, প্রকল্প (নতুন ব্রিজ নির্মাণ+পুরাতন ব্রিজ সংস্কার) থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তবে এসব টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে কি-না প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘এই কাজের দুটো অংশ। এক, নতুন ব্রিজ নির্মাণ আর পুরাতন ব্রিজগুলো সংস্কার করা। নতুন ব্রিজ চালু হলে তখন পুরাতন ব্রিজগুলো ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন সংস্কার শুরু হবে। সুতরাং টাকা ফেরত যাওয়ার কথা এই মুহূর্তে আসে না। সেটা হবে সব সম্পন্ন করার পরে।’
এর আগে মেঘনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক শওকত আহমেদ মজুমদার জানিয়েছিলেন, ১১টি পিয়ার ও দুটি অ্যাপার্টমেন্ট জয়েন্টের ওপরে নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৮শ’ কোটি টাকা। পুরনো মেঘনা সেতু সংস্কারে ব্যয় হবে আরও ৪০০ কোটি টাকা। মোট ব্যয় হবে ২২শ’ কোটি টাকা। সেতুর ঢাকা প্রান্তে প্রায় এক কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম প্রান্তে এক কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং পশ্চিম পাশে সেতুর নিচ দিয়ে ৫০৭ মিটার দৈর্ঘ্যের সার্ভিস রোড নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কাচঁপুর, দ্বিতীয় মেঘনা এবং দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণ এবং পুরনো তিনটি সেতুর সংস্কারসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি হয়েছিল প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার।
প্রায় সাত মাস আগে এই নতুন তিনটি সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানান প্রকল্প ব্যবস্থাপক শওকত আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এই প্রথম কোনও বড় প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের আগে সম্পন্ন হয়েছে এবং ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। এটি বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকারের জন্য একটি মাইফলক ও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
জাপানিদের কাজের প্রশংসা করে মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘জাপানিরা কাজ নেয়ার পর তারা অসম্ভব সিনসিয়ার। তারা খুব পরিকল্পনা করে কাজ করে। অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কাজে কখনই বিলম্ব করে না। যেটুকু বিলম্ব হয় সেটা হয়তো অন্য কোনো কারণে, তবে সেটা কাভার করার জন্য তারা জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে।’
তবে জাপানিদের কাজের মূল্য স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বলেও জানান তিনি। নুরুজ্জামান বলেন, ‘ভালো জিনিস পেতে হলে একটু বেশি টাকা তো দিতেই হবে। ওরা কৃপণ মানে কী, ওরা হাড়-কিপটা। সাইটে গেলে আমাদেরকে নিজেদের ৬০ টাকায় ওদের ওখানে ভাত খেতে হয়। গাড়ির চালকরা ৩০ টাকা দিয়ে ভাত খান। এখানে ওদের কোনোরকম খাতির-যত্ন নাই। আর মিটিংয়ে শুধুমাত্র এক কাপ চা খাওয়ায়। ওদের সঙ্গে মিশলে প্রথম প্রথম মনে হবে ওরা বোধহয় অভদ্র। কিন্তু পরে বুঝবেন, এটা বোধহয় ওদের জাতিগত কৃতিত্ব।’
তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে মেঘনা দ্বিতীয় সেতুর জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে এই সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করেছে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাশ্রয় হয়েছে এই সেতু থেকে ৫০০ কোটি টাকা।
গোমতী সেতুর জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার মধ্যে এই সেতুর কাজ শেষ করেছে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সেতু থেকে সাশ্রয় হয়েছে ৪৬০ কোটি টাকা। আর কাঁচপুর সেতুর জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তবে এই প্রকল্প কত টাকার মধ্যে শেষ করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানগুলা, তা জানা যায়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন