পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনের জন্য অস্বাভাবিক মূল্যে আসবাবপত্র কেনা ও ভবনে উঠানোয় নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।
রোববার (১৯ মে) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন জনস্বার্থে এ রিটটি করেন।
সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সরওয়ারদীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি হতে পারে বলে জানান সুমন।
রিটে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব, পাবনার গণপূর্ত অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে বলেও জানান ব্যারিস্টার সুমন।
তিনি বলেন, ঘটনায় খবর প্রকাশ হওয়ার পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। যেহেতু তাদের কর্মচারীররা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাতে সেই কমিটি দিয়ে তদন্ত না করে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করার দাবিতে রিট করেছি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের গ্রিন সিটি আবাসন পল্লীর ভবনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ও তা ভবনে তোলায় অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে গত ১৬ মে দৈনিক বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
রিটকারী আইনজীবী সুমন জানান, ওইসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করে এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে এ আবেদনটি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ওই প্রকল্পের জন্য গ্রিন সিটি আবাসন পল্লীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য যে ভবন সেখানকার ফার্নিচার থেকে শুরু করে অন্যান্য জিনিস অস্বাভাবিক দামে কেনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তা ভবনে তোলায়ও অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে। রিট আবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছি, এটি তদন্ত করার জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হোক যাতে বোঝা যাবে আসলে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে এবং কারা দায়ী।
তিনি আরও বলেন,গণপূর্ত অধিদফতর এ ঘটনা তদন্ত করবে বলে জেনেছি। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাই যদি তদন্ত করে তাহলে তদন্ত কার্যক্রম বিশ্বাসযোগ্য হবে না। এ জন্যই বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের ২০ ও ১৬ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটে একটি বৈদ্যুতিক কেটলি নিচ থেকে উপরে তুলতেই খরচ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার টাকা। একই রকম খরচ দেখানো হয়েছে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি ইলেকট্রিক আয়রন উপরে তোলার ক্ষেত্রেও। একেকটি ওয়াশিং মেশিন উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকারও বেশি। এভাবে ওয়াশিং মেশিনসহ অন্তত ৫০টি পণ্য উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ক্রয়মূল্যের প্রায় অর্ধেক। প্রায় ৮ হাজার টাকা করে কেনা প্রতিটি বৈদ্যুতিক চুলা ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে খরচ দেখানো হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার টাকার বেশি। ৩৮ হাজার ২৭৪ টাকা দরে কেনা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৮৪০ টাকা করে। অস্বাভাবিক এ অর্থ খরচ শুধু ভবনে উঠানোই নয়, আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে। প্রতিটি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা করে।
এ হিসাবে ৩৩০টি চাদর কিনতে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮০ টাকা। কাপড় পরিষ্কারের জন্য ১১০টি ওয়াশিং মেশিনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা করে। ১১০টি টেলিভিশনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬০ টাকায় এবং সেগুলো রাখার জন্য টেলিভিশন কেবিনেট কেনা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে। একেকটি ড্রেসিং টেবিল কেনা ২১ হাজার ২১৫ টাকায়, আর উঠাতে খরচ ৮ হাজার ৯১০ টাকা করে দেখানো হয়েছে। এছাড়া রুম পরিষ্কার করার মেশিন কিনতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ১৮ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। প্রতিটি চুলা কিনতে খরচ করেছে ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ দেখিয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। ছয়টি চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের একেকটি সেট কেনা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকায়, ভবনে তুলতে লেগেছে ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা করে। ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা দরে ওয়ারড্রোব কিনে ভবনে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৯ টাকা করে।
৩৬ হাজার ৫৭ টাকা দরে ৩৩০টি ম্যাট্রেস ও তোশক কেনা হয়েছে মোট ১ কোটি ১৯ লাখ টাকায়, যার প্রতিটি ভবনে উঠাতে খরচ করা হয়েছে সাত হাজার ৭৫২ টাকা করে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকা দরে ১১০টি খাট কিনতে খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ টাকা। খাটগুলোর প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটে নিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ টাকা। একেকটি সোফা কেনা হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে। ১৪ হাজার ৫৬১ টাকা দরে কেনা সেন্টার টেবিলের প্রত্যেকটি ভবনে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৪৮৯ টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, অস্বাভাবিক দামে এসব আসবাবপত্র কেনার পর তা ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে উঠানোর এ ঘটনা ঘটিয়েছেন গণপূর্ত অধিদফতরের স্থানীয় কর্মকর্তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন