বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ পরীক্ষায় বিভিন্ন অনিয়মের সুস্পষ্ট তথ্য প্রমাণাদি পেয়েছেন অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ছয়টি সুনির্দিষ্ট অনিয়মের এসব তথ্য তুলে ধরে তারা পুনরায় নিয়োগ পরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
গত ১২ মে রবিবার লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকেই ফল বাতিল ও উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন এসব পরীক্ষার্থী।
শনিবার অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পরীক্ষার আগে ও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রশাসনকে লিখিত প্রমাণসহ জানানো হয়। কিন্তু উপাচার্য বারবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার কথা বলে কোন অভিযোগই আমলে নেননি। আমরা মনে করি প্রধানমন্ত্রীর সামনে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি তুলে ধরলে তিনি এই নিয়োগ বন্ধের নির্দেশ দেবেন।
সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এসব অনিয়ম তুলে ধরেন পরীক্ষার্থীরা। পরে দেশ রূপান্তরের কাছে অনিয়মের পক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এবং উপাচার্যের বিভিন্ন বক্তব্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তথ্যাদির নানা অমিল খণ্ডন করেন।
পরীক্ষার্থীদের এসব অভিযোগ খণ্ডন করতে এবং সঠিক তথ্য জানাতে শিগগির বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সবার সঙ্গে বসবো। এসব অভিযোগের ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানতে কি করা যায় সিদ্ধান্ত নেব। পরে সাংবাদিকদের ডেকে বিষয়গুলো জানানো হবে।
তবে উপাচার্য পরীক্ষার্থীদের এসব অভিযোগকে ‘বাজে কথা’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। হলে ১৮ শ পরীক্ষার্থী নিশ্চয় বসে থাকত না। প্রতিবাদ করত।
সংবাদ সম্মেলনে ও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বজনপ্রীতি প্রসঙ্গে পরীক্ষার্থীরা জানান, লিখিত পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ছেলে, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মেয়ের জামাই, উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী-২ এর স্ত্রীসহ অনেকেই উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ ও পরীক্ষাকেন্দ্রে সরবরাহের দায়িত্বে এবং উপাচার্য নিয়োগ পরীক্ষা বিষয়ক কমিটির সভাপতি।
স্বজনপ্রীতির ব্যাপারে উপাচার্য তার ছেলে ডা. সুব্রত বড়ুয়া প্রসঙ্গে বলেন, সে ‘মেধার কারণে উত্তীর্ণ হয়েছেন ও কোন প্রভাব খাটানো হয়নি’। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরীক্ষার্থীরা। তারা জানান, উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া যখন বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) সভাপতি, তখন তার ছেলে সেখান থেকে এফসিপিএস প্রথম পার্ট করেন। পরে যখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, তখন তার নিজ বিভাগ নিউরো সার্জারি থেকে ছেলে এমএস করেন। এমনকি এমএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণের তালিকায় প্রথমে ছেলের নাম ছিল না, পরে যুক্ত করা হয়েছে। ডা. সুব্রত বিশেষ বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন নি বলেও জানান পরীক্ষার্থীরা।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ বছর মানা হয়নি বলে জানান পরীক্ষার্থীরা। এ পর্যন্ত দু’জনের নাম জানা গেছে। এদের মধ্যে ডা. বিদ্যুৎ কুমার সূত্রধর ডেন্টাল সার্জারি নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। রোল নম্বর ৮১১৮০। তার বর্তমান বয়স ৩৮। কিন্তু আবেদনপত্রে বয়স ৩০ বছরের কম উল্লেখ করা হয়। তার আবেদনপত্রে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাতের সুপারিশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে। অন্যজন ডা. বাদশাহ আলমগীর। রোল নম্বর ৪৫৫৩২। আবেদনপত্রে দেওয়া জন্ম তারিখ (১৬ অক্টোবর ১৯৮৩) অনুযায়ী তার বয়স ৩৬ বছর।
পরীক্ষার্থীরা বলেন, আমরা উপাচার্যকে পরীক্ষার (২২ মার্চ) আগেই গত ৯ মার্চ অভিযুক্তদের তথ্য যাচাই করতে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল অভিযুক্তরা উত্তীর্ণ হয়েছেন। অথচ বয়স বেশি হওয়ায় মেডিকেল অফিসার পদে ৭৩ ও ডেন্টাল পদে ১৯ জনের আবেদন বাছাই শেষে বাতিল করা হয়। দেশ রূপান্তরের কাছে পরীক্ষার্থীরা প্রশ্ন রাখেন- তা হলে কি প্রশাসন স্বজনপ্রীতি করতে ও তদবির বজায় রাখতে ইচ্ছে করেই এসব ত্রুটিপূর্ণ আবেদন বহাল রেখেছেন?
প্রবেশপত্র ও প্রার্থী তালিকায় নানা অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে।। এর মধ্যে ডেন্টাল সার্জারি বিভাগে উত্তীর্ণ ডা. মাহফুজুর রহমানের একাধিক রোল নম্বর ও এই রোল নম্বরে একাধিক প্রার্থীর নাম পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডা. মাহফুজুর রহমানকে বৈধ পরীক্ষার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কাগজপত্রে দেখা গেছে, ডা. মাহফুজুর রহমানের মূল প্রবেশপত্রে কোন ছবি ও সিল নেই এবং রোল নম্বর ৭১৩০৩। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত বৈধ প্রার্থী তালিকায় তার রোল নম্বর ১১১৬৭ উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বৈধ প্রার্থী তালিকার ৩৭ নম্বর পৃষ্ঠায় দেখা গেছে, ৭১৩০৩ রোল নম্বর এর প্রার্থীর নাম ডা. সাবরিনা বিনতে খায়ের, পিতা/স্বামী মো. আবুল খায়ের। উত্তীর্ণের তালিকায় ৭১৩০৩ নং রয়েছে।
এ ছাড়া ডেন্টাল সার্জারি বিভাগে উত্তীর্ণ ডা. দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়ার (রোল নং ৭০৯৩৪) প্রবেশপত্রে ঠিকানা ও সিল নেই বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত পরীক্ষার্থীরা।
ডেন্টালের প্রার্থীদের মেডিকেলের প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কাগজপত্রে দেখা গেছে, পরীক্ষার্থী ডা. মো. জসীম উদ্দিন (রোল নং ১১৩৮৭, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ) পরীক্ষার (২২ মার্চ) পর গত ১০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর এ ব্যাপারে লিখিত আবেদন করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি ডেন্টালের পরীক্ষার্থী হলেও তাকে এমিবিবিএসের প্রবেশপত্র ও পরীক্ষা কেন্দ্রে এমবিবিএসের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। কেন্দ্রে তিনি হল পরিদর্শককে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ‘রোল অনুযায়ী প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়েছে’ বলে জানান। ডা. জসীম উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এমনকি পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাও নেয়নি।
এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষার আরও কিছু অসংগতি তুলে ধরেন পরীক্ষার্থীরা। তারা বলেন, গত ৬ মাস আগে বিএসএমএমইউতে বিতর্কিত প্রশ্নপত্রে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার নির্ধারিত দিনের চার দিন আগে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উপস্থিতিতে একটি কক্ষে প্রশ্নপত্র খোলা হয়। এখানে বিতর্কিত প্রার্থীদের প্রশ্নপত্র দেখানো হয়। এ ছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে মোবাইল ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে উত্তরপত্র সরবরাহের ঘটনা ঘটে। এমনকি ফল প্রকাশের আগেই রোল নম্বরসহ ফলের তালিকার একটি অনুলিপি পাওয়া গেছে। পরে প্রকাশিত তালিকার সঙ্গে ফলাফলের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে ছেলেটার বয়স বেশি ছিল, আমরা তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি। বিএমডিসিকে বলেছি ব্যবস্থা নিতে। মাহফুজুর রহমান নামে যাকে অবৈধ প্রার্থী বলা হচ্ছে, তিনি বৈধ পরীক্ষার্থী। আমরা যাচাই-বাছাই করেছি। তার নামে একাধিক রোল নম্বর ও পরীক্ষার্থীর নামের বিষয়টি খতিয়ে দেখব। তবে এমবিবিএসের প্রশ্নে ডেন্টালের পরীক্ষার বিষয়টি উপাচার্য খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন অভিযোগ সংবলিত লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন পরীক্ষার্থী ডা. মাইদুল হাসান। অন্যান্য পরীক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডা. সোহরাব হোসেন তমাল, ডা. আব্দুর রহিম খান তুষার, ডা. রাফি শারজিন, ডা. নাইমুল হাসান প্লাবন, ডা. দাউদ চৌধুরী পলাশ ও ডা. মোবিনুর রহমান মবিন।
গত ২০ মার্চ ২০০ জন মেডিকেল অফিসার ও ডেন্টাল সার্জারির নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফল প্রকাশ হয় গত ১২ মে রবিবার। ৮২০ জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চূড়ান্ত নিয়োগের লক্ষ্যে তাদের ৫০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন