জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় দিন, বৃহস্পতিবার (১৬ মে) দুপুর সাড়ে ১২টা। মাথার ওপর প্রখর সূর্যকিরণ। হাইকোর্টের অদূরে শিক্ষা ভবনের সামনে যানজটে স্থবির হয়ে আছে সচিবালয়মুখী যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার, জিপ, মোটরসাইকেল ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা। প্রচন্ড গরমে সকলেই গামছা বা রুমাল দিয়ে বারবার ঘাম মুছছেন। যানজটে অসংখ্য যানবাহন থেমে থাকলেও সবার দৃষ্টি একটি মোটরচালিত অটোরিকশার চালকের দিকে।
সবার দৃষ্টি তার ওপর পড়ার কারণ তিনি স্বাভাবিক আর দশজন চালকের চেয়ে ব্যতিক্রম। লিঙ্গ বিবেচনায় চালক একজন নারী। পরনে সালোয়ার কামিজ। গরমের হাত থেকে বাঁচতে মাথায় ওড়না জড়ানোর পাশাপাশি পড়েছেন লম্বা টুপি। পায়ে জুতো নেই। রোদে পুড়ে শরীরের রঙ তামাটে আকার ধারন করেছে। ডানহাতে একটি চুড়ি থাকলেও দু’হাতে শক্ত করে ধরেছেন অটোরিকশার হ্যান্ডেল। হ্যান্ডেলের পাশে একটি গামছা বাঁধা। একটু পরপর ঘর্মাক্ত মুখখানা মুছছেন তিনি।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সুমি আক্তার নামের ওই অটোরিকশা চালক জানান, গত ৮ বছর ধরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। বছর দশেক আগে স্বামী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় দুই সন্তানকে নিয়ে চারদিক অন্ধকার দেখেন সুমি। অনেকের কাছ থেকে ঋণ করে ও চেয়েচিন্তে (সাহায্য নিয়ে) কিছুদিন চললেও এক সময় বুঝতে পারেন এভাবে জীবন চলবে না।
প্রথমে কামরাঙ্গীরচরের এক রিকশা গ্যারেজ মালিকের কাছে সংসারের বেহাল দশার কথা বলে রিকশা ভাড়া নিয়ে গ্যারেজের আশেপাশেই চালানো শিখেন। ভালোভাবে চালানো শিখে রাস্তায় নামেন তিনি। সেই থেকে চলছে নিত্যদিনের জীবন যুদ্ধ।
সুমি জানান, গত ছয় বছর রিকশা চালিয়ে সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জুটিয়েছেন। দেড় বছরেরও বেশি সময় হলো অটোরিকশা চালাচ্ছেন। প্রতিদিন ভোরে ওঠে স্বামী ও সন্তানদের জন্য রান্না শেষ করে অটোরিকশা নিয়ে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। প্রতিদিনের জমা ৪শ’ টাকা মহাজনকে দেয়ার পর কোনো দিন ২০০ টাকা বা কোনো দিন ৩০০/৪০০ টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন।
তিনি বলেন, ভাড়ার বদলে নিজের একটি অটোরিকশা কেনার জন্য কিছু টাকা জমিয়ে আসছিলাম। কিন্তু বাড়ি ভাড়া, খাবার-দাবার খরচ, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা আর দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে গিয়ে জমানো টাকাও ভাঙতে বাধ্য হয়েছি।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এ প্রতিবেদকের কাছে সুমি বলেন, নিজের একটি অটোরিকশা থাকলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০/৬০০ টাকা আয় করতে পারতাম। সংসার চালানো পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়াটাও করাতে পারতাম।
আলাপের ফাঁকেই সিগন্যাল ছেড়ে দিলে যানজট কমতে থাকে। খালি পায়ে এক্সিলেটর ধাবিয়ে সুমি ছুটে চলে গন্তব্যের দিকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন