‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়, ধনী-গরিব সবায় খায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’। রমজানের পুরো মাসজুড়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার ইফতার বাজারে কান পাতলেই শোনা যায় এমন ছন্দময় হাঁকডাক। বৈচিত্র্যময় ইফতারের মধ্যে এই আইটেমটি দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে স্বাদে ও রুচিতে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে বলে জানা যায়।
এত লম্বা করে না বলে সাধারণত এই আইটেমটিকে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নামেই ডাকা হয়। এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনা মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা-কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ২৪ ধরনের মসলা প্রয়োজন। একটি পিতলের বড় থালে সব কিছু দুই হাতে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙ্গায় করে বিক্রি করা হয়।
কেবল এই আইটেমটির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা ছুটে আসেন চকবাজারে। এখনও পুরান ঢাকার এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের এই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ছাড়া ইফতার জমে না, পূর্ণতা পায় না। নতুন ঢাকার বাসিন্দারাও দিন দিন এই খাবারটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। রোজায় এই ইফতার পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে।
মূলত রমজান মাসজুড়ে ইফতার কেনাকাটা ও দিনান্তে বৈচিত্র্যময় ইফতার দিয়ে রোজা ভাঙা যেন এক ধরনের উৎসবময় ব্যাপার। এই সময়টাতে দেশের শহর-গ্রামগঞ্জ এমনকি পাড়ার অলিতেগলিতেও চলে ইফতার বেচাবিক্রি। ইফতার আয়োজনে শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পুরান ঢাকা। প্রতিবছর রমজান এলেই রাজধানীর পুরান ঢাকার প্রায় পুরো এলাকা হয়ে উঠে ইফতার বাজার। দুপুরের পর পরই স্থায়ী হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ফুটপাতের অস্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ ইফতার দোকান জমে উঠে বাহারি ইফতারের পসারা সাজিয়ে।
ইফতারের যত ধরনের আয়োজন আছে; প্রায় সবগুলিরই দেখা মিলে পুরান ঢাকায়। কোয়েল পাখির রোস্ট থেকে শুরু করে পেস্তাবাদামের শরবত, বিশাল শিকের সঙ্গে জড়ানো সুতি কাবাব, দেড়-দুই কেজি ওজনের জাম্বো সাইজ জিলাপি, মোরগ-পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, বড় বাপের পোলায় খায়, নানা রকম ভাজা, মুড়ি, ঘুগনি, ছোলা এরকম আরও কত কী! এরমধ্যে এমন অনেক আইটেম আছে, যেগুলো সেই মোগল আমল থেকে ইফতারের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে প্রচলিত।
এছাড়াও এখানকার বাহারি ইফতারের মধ্যে রয়েছে শিকের সঙ্গে জড়ানো সুতি কাবাব, জালি কাবাব, শাকপুলি, টিকা কাবাব, আস্ত মুরগির কাবাব, মোরগ মসল্লম, বঁটি কাবাব, কোফতা, চিকেন কাঠি, শামি কাবাব, শিকের ভারী কাবাব, ডিম চপ, তেহারি, মোরগ পোলাও, কবুতর ও কোয়েলের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, মোল্লার হালিম, নুরানি লাচ্ছি, পনির, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, ছানামাঠা, কিমা পরোটা, ছোলা, মুড়ি, ঘুগনি, বেগুনি, আলুর চপ, পেঁয়াজু, আধা কেজি থেকে পাঁচ কেজি ওজনের জাম্বো সাইজ শাহি জিলাপিসহ নানা ধরনের খাবার।
রমজানের পুরো মাসজুড়ে আতা-আনারস-বিলেতি গাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফল, পিঠা-পায়েস, মিষ্টিসহ নানা সামগ্রী সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা।
এ ব্যাপারে ডিসেন্ট বেকারির মালিক ব্রেকিংনিউজকে বলেন, ‘রমজান উপলক্ষে আমাদের বেচাকেনা অনেক ভালো হচ্ছে। তবে রমজানের শেষের দিকে অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে যায়; তাই তখন বেচোকেনা কিছুটা কমতে শুরু করে।’
ঐতিহাসিকদের মতে, মোগল আমল থেকেই ঢাকায় বাহারি ইফতারের প্রচলন ঘটে। বাহারি ইফতারের আলোচনা এলেই সবার আগে চলে আসে পুরান ঢাকার চকবাজার-এর কথা। এখন ইফতার বাজার ছড়িয়ে পড়েছে পুরান ঢাকার বিস্তৃত এলাকায়।
বিশেষ করে বাংলাবাজার, সদরঘাট, নবাবপুর, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, গুলিস্তান, কোর্ট-কাচারী এলাকা, ওয়ারী, লক্ষ্মীবাজার, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, সুরিটোলা, কাপ্তান বাজার, চানখাঁরপুল, আজিমপুর, টিপুসুলতান রোর্ড, ধোলাইখালসহ নানাস্থানে এখন বাহারি ইফতার পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে ইফতার বাজারে এ বছর শাহী ইফতার নিয়ে এসেছে ডিসেন্ট বেকারি, আনন্দ বেকারি, ইউসুফ বেকারি, রস, আল-রাজ্জাক, ঢাকা বিরিয়ানী হাউজ-এর মতো প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মোগল ফুডস ইফতার বাজারে এনেছে নতুন বৈচিত্র্য। সব মিলিয়ে পুরান ঢাকার ইফতার বাজার এখন জমজমাট। দুপুর একটার পর পরই ইফতার বাজার বসছে প্রতিটি রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, গলির মোড়ে মোড়ে। বিকেল নামার আগেই রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হাজার হাজার ক্রেতা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন পছন্দ ও আনন্দের এই ইফতার বাজারে।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন