হোয়াটসআপে স্বজনদের সাথে আলাপের পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনা, পোষা গরু হাঁস মুরগি দেখে গেছে তিউনিসিয়ায় নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ হবিগঞ্জের লুকড়া গ্রামের মোক্তাদির।
লিবিয়ায় একটি ঘরে আটকে থাকা অবস্থায় সে বাড়ির আঙ্গিনা ও লোকজনকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে দেখতে পাননি মা, বাবা, স্বজনরা। কারণ ঘরটি ছিল অন্ধকার।
৭ মে মাত্র ৫ মিনিট আলাপে মোক্তাদির জানিয়েছিল যে কোন সময় তাদের সমুদ্র পাড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। নৌকায় পাড়ি দিতে হবে সমুদ্র। বেঁচে থাকলে দেখা হবে, নয়তো এটাই হবে শেষ আলাপ।
বুধবার দেশ রূপান্তরের সাথে আলাপে জানাচ্ছিলেন নিখোঁজ মোক্তাদিরের চাচা আব্দুল খালেক।
সদর উপজেলার পুকড়া গ্রামের আব্দুল জলিল ও ফাতেমা বেগম দম্পতির ৩ ছেলে ও ২ কন্যার মধ্যে মোক্তাদির (২২) সবার বড়। সে হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজের ডিগ্রির ছাত্র। একই সাথে সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অফিসের মাস্টাররোল ভিত্তিক এমএলএলএস হিসেবে চাকুরী করতো।
খালেক জানান, পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বিদেশ যেতে চেয়েছিল মোক্তাদির। ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে সে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে দুবাই চলে যায়। পরে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় দেশে। ইতালি হয়ে ফ্রান্স যেতে চেয়েছিল সে।
বিদেশ পাগল মোক্তাদির এ বছর শুরুতে একই কায়দায় ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে দালালদের সহযোগিতায় চট্রগ্রাম-ঢাকা-কলিকাতা-শ্রীলংকা-তুরস্ক হয়ে লিবিয়া পৌঁছায় ৪ মাস আগে।
গত ৮ মে সমুদ্র পাড় থেকে মোবাইলে স্বজনদের কাছে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠায় যে, বোটে চড়ে সে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে সমুদ্র পাড়ি দিতে রওনা হয়েছে।
খালেক জানান, মোক্তাদির ছাড়াও লুকড়া গ্রামের তিন কলেজ ছাত্র কাইউম, নূরুল আমিন ও মামুনকে বানিয়াচঙ্গ উপজেলার হিয়ালা গ্রামের মোজাক্কির ও ঢাকার রহমত নামে দুই দালাল ইতালি পাঠানোর দায়িত্ব নেয়।
ঘটনার দিন আব্দুল কাইয়ুম, আব্দুল মোক্তাদির ও মামুন মিয়া একটি নৌকায় উঠেন। নৌকাডুবিতে মামুন উদ্ধার হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন মোক্তাদির আর কাইয়ুম।
অপর একটি নৌকায় ওঠা নূরুল আমিন নিরাপদেই ইতালি পৌঁছেছেন জানিয়ে বাড়িতে ফোন করেছেন।
উদ্ধার হওয়া মামুন টেলিফোনে মামা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য জাহির মিয়াকে ফোনে বলেছেন, নৌকা ডুবে যাওয়ার পরও মোক্তাদিরের সঙ্গে তিনিও সাঁতার কাটতে থাকেন। এক পর্যায়ে হাত ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণ পর আর তাকে খুঁজে পাননি।
খালেক জানান, দেশের বাইরে নেওয়ার পর পরই টাকার জন্য দালালদের আসল রূপ দেখা যায়। কিছুদিন পর পর মোক্তাদির টাকা দেওয়ার জন্য পরিবারকে চাপ দিত। নইলে দালালরা তাকে মেরে ফেলবে এই বলে কান্নাকাটি করতো। ফলে নির্দিষ্ট মোবাইলে বিকাশে টাকা পাঠাতে হতো।
ইতোমধ্যে ৯ লাখ টাকা দালালরা নিয়ে গেছে জানিয়ে খালেক বলেন, এসব দালালদের খপ্পরে পড়লে মানুষ আর মানুষ থাকে না। দালালদের পাওনা মিটাতে জমি বিক্রি, চড়া সুদে ঋণ করতে হয়েছে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তিনি দালাল রহমতের সাথে যোগাযোগ করলে সে জানায়, মোক্তাদিরসহ সবাই ইতালি পৌঁছে গেছে। গেইম শেষ (গোপনে যাত্রীদের বোটে সমুদ্র পাড়ি দেওয়াকে গেম বলে পাচারকারীরা )।
নিখোঁজ আব্দুল কাইয়ুমের বাবা হাজী আলাউদ্দিন বলেন, আমার ৮ ছেলে। এর মাঝে নিখোঁজ ছেলেটি সবার ছোট। অনার্স ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখত সে। এক পর্যায়ে বিদেশে যাওয়ার কথা বলে। তার স্বপ্ন পূরণে ৯ লাখ টাকা দিতে সম্মত হই। কিন্তু এখন আমার ছেলেটাই নাই! বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
গত ৯ মে গভীর রাতে লিবিয়া উপকূল থেকে ৭৫ জন অভিবাসীবাহী একটি বড় নৌকা ইতালি পাড়ি জমায়। নৌকাটি তিউনিসিয়া উপকূলে ডুবে গেলে বেশির ভাগ যাত্রীর মৃত্যু হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন