জানুয়ারি মাস। হঠাৎ দেখা গেল শাহবাগ এলাকায় অনেক মানুষের জটলা। ভিড় ঠেলে দেখা গেল, এক পুলিশ কনস্টেবল রিকশাওয়ালাকে বেধরক পেটাচ্ছেন। পাশেই একজন সাগ্রহে জানালেন, তেমন কিছু না- ট্রাফিক সিগনাল অমান্য করায় রিকশাওয়ালাকে পিটুনি দেওয়া হচ্ছে। সে সময় হেঁটে যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী।
রাব্বানীই প্রথম প্রতিবাদ করেন। পুলিশ কনস্টেবলকে বলেন, আপনি আইন নিজে হাতে তুলে নিতে পারেন না। রিকশাওয়ালাকে কেন মারলেন? উত্তর দিতে পারেননি ওই পুলিশ সদস্য। এরপর রিকশাওয়ালাকে রাব্বানী বলেন, আপনি কি মামলা করতে চান? জবাবে রিকশাওয়ালা বলেন, স্যার, পুলিশ আমার মামলা নেবে না। রাব্বানী বলেন, আপনি মামলা করতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করব। এক পর্যায়ে পুলিশ কনস্টেবল ভুল স্বীকার করেন। বিষয়টির সেখানেই মীমাংসা হয়ে যায়।
রাব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে রিকশাওয়ালা ঠিক করেননি। আবার পুলিশ তার গায়ে হাত তুলেছেন, সেটাও ঠিক হয়নি। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।
বুধবার (১৭ এপ্রিল) রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একই ঘটনা দেখা যায়। দু‘জন পুলিশ কনস্টেবল এক রিকশাওয়ালাকে বেধরক পিটুনি দেন। পথচারীরা এর প্রতিবাদ করে। এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে আসেন ট্রাফিক পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। পুরো ঘটনা জেনে তিনি ভুল স্বীকার করেন।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, অপরাধ যত ছোটই হোক না কেন, অপরাধ অপরাধই। অপরাধী যে-ই হোক তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তারপরও রাজধানীজুড়ে রোজই চোখে পড়ে এমন দৃশ্য। অভিযোগ দায়ের না হওয়ায় নজর এড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশের এসব ছোট ছোট অপরাধ। কেবল গায়ে হাত তোলা নয়, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ভোমর, বেঁত এমকি বিদ্যুতের মোটা তার ব্যবহার করতে দেখা যায়। ট্রাফিক আইন ভাঙলে কিংবা কোনো রাস্তায় মাথায় রিকশা পার্কিং করলে ভোমর দিয়ে চাকা ফুটো করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ওবায়দুর রহমান জানান, ‘পিস্তল, শটগান, রাইফেলস, এলএমজি, এসএমজি এগুলো পুলিশের বৈধ অস্ত্র। সোয়াত ও সিটিটিসিতে এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। এসব অস্ত্রের নিবন্ধন নম্বর রয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে পুলিশ লাঠি ব্যবহার করে। কিন্তু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোনো পুলিশ সদস্য যদি বেঁত বা ভোমর ব্যবহার করে থাকেন, সেটা তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে করছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী পুলিশ কাউকে মারধর করতে পারে না। রিকশাওয়ালারা ট্রাফিক আইন একেবারই মানতে চায় না। তাই অনেক সময় হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তবে সেটা ঠিক না। হাওয়া ছেড়ে দেওয়া বা চাকা ফুটো করে দেওয়া এগুলো কোনোটাই ঠিক না।’
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনাগুলো আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। পুলিশ সদস্যদের কাউন্সেলিং করা হয়। যার যার জায়গা থেকে আইন মানলে এমন ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।’
ট্রাফিক পরিস্থিতি, যা মনে করে জনসাধারণ
রাজধানীর মৎসভবন এলাকায় দু’জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে রিকশা যেন মূল সড়কে আসতে না পারে, সেই দায়িত্বে রয়েছেন একজন আনসার সদস্য। তারপরও শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়কে।
জানতে চাইলে পথচারী আবরার সুমন সারাবাংলাকে বলেন, সবারই দোষ আছে। রিকশাওয়ালা অধিকাংশরাই ট্রাফিক আইন জানেন না। তারা লেন বোঝেন না। অল্প জায়গা পেলেই সেখানে রিকশা ঢুকিয়ে দেন। তারপরও তাদের গায়ে হাত তোলা অমানবিক। পুলিশ বা আনসার সদস্য রিকশার হাওয়া ছেড়ে দিতে পারেন না বা চাকা ফুটো করে দিতে পারেন না।
আরেক পথচারী নাজমুল ইসলাম বলেন, মূল সড়কে রিকশা চলে যায় অসৎ আনসারদের কারণে। অনেক সময় ৫ টাকা বা ১০ টাকা নিয়ে আনসার সদস্য রিকশা ছেড়ে দেন। ওই চালক যখন মূল সড়কে যাচ্ছেন, তখন ট্রাফিক পুলিশ ধরে ফেলছেন। কখনো কখনো তাদের গায়ে হাত তুলছেন। ঘটনা যাই ঘটুক, কারো গায়ে হাত তোলা অন্যায়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা জজ কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট জাহিদ হাসান বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি থানা এবং আদালত উভয় জায়গায় মামলা করতে পারেন। মারধরের মাত্রার ওপর নির্ভর করে আদালত শাস্তির পরিমাণ ঠিক করবেন। মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ থানায় যেতে হবে। থানা যদি মামলা না নেয়, আদালতে মামলা করার সুযোগ আছে।’
রিকশাওয়ালাদের অভিযোগ
নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় এসেছেন সাইফুল ইসলাম। সেগুনবাগিচা এলাকায় রিকশা চালান তিনি। সাইফুল সারাবাংলাকে বলেন, মার তো প্রায়ই খাই। মৎস ভবনের সামনে রিকশা দাঁড় করাতে আনসার সদস্যকে ১০ টাকা করে দিতে হয়। একদিন টাকা না দিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম। আনসার সদস্য এসে আমার রিকশা উল্টে দেয়, মারধর করে। রিকশা সিট কেড়ে নিয়ে রেখে দেয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ, প্রতিবাদ করে কী হবে! কে শুনবে আমাদের কথা? মামলা করার সাহস পাই না। আমাকে যখন আনসার সদস্য মারধর করছিল, তখন বড় মোবাইল (ওয়াকিটকি) হাতে আরও একজন বড় অফিসার আসেন সেখানে। এসে বললেন, মার, আরও মার। এরপর আর কোন সাহসে মামলা করতে যাব?
রুহুল আমিনের বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলায়। তিনি রিকশা চালান মালিবাগ-মগবাজার-বাংলামোটর এলাকায়। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনিও তার অভিজ্ঞতা জানালেন। রুহুল আমিন বলেন, সবাই দ্রুত সিগনাল পার হতে চায়। রিকশায় বসে থাকা যাত্রী আমাদের বলেন, তাড়াতাড়ি যাও, তাড়াতাড়ি যাও, সিগনাল পার হও। পেছন থেকে প্রাইভেট গাড়ি হর্ন দিতে থাকে। সে রকম একদিন বাংলামোটর মোড়ে সিগনাল দেয় ট্রাফিক পুলিশ। আমার সামনের চাকা ক্রসিংয়ে (জেব্রা ক্রসিং) উঠে গিয়েছিল। ট্রাফিক পুলিশ আমাকে বললেন, রিকশা পেছনে নিতে। কিন্তু ততক্ষণে আমার পেছনে অনেক গাড়ি জমে গিয়েছিল, পেছানোর জায়গা ছিল না। ট্রাফিকের হাতে থাকা লাঠি দিয়ে তিনি আমাকে জোরে মারলেন।
আমি পায়ের ব্যথায় কাঁদতেছি তখন। আমি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে দু’জন লোক প্রতিবাদ করলেন। ট্রাফিক পুলিশ তাদের বক্সে নিয়ে গেলেন। এরপর সিগনাল ছেড়ে দিলো, আমি আর দাঁড়াতে পারিনি। ব্যস্ত সড়ক, পেছন থেকে গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। আমার যাত্রীও বললেন, দেরি হয়ে গেছে, চলেন- বলেন রুহুল আমিন।
এ ব্যাপারে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক সদস্যকে ধৈর্য্য নিয়ে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো হয়। কমিশনার মহোদয় নিজেও সব সময় খোঁজ-খবর নেন। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে।’
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন