রাজধানীর শেওড়া রেলস্টেশনের জেব্রাক্রসিং দিয়ে গত সোমবার বিকালে রাস্তা পার হচ্ছিলেন রাজধানীর সেন্ট জোসেফ কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র আদনান তাসনিম। কিন্তু ঘাতক বাস নিয়ম থাকার পরও থামল না। দ্রুত গতিতে এসে ধাক্কা দেয় তাসনিমকে। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে গেলে সেখানকার ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এভাবেই ঝরে যায় একটি নবীন প্রাণ। ঝরে যায় একটি সম্ভাবনা। প্রতি দিনই সড়কে ঝরছে এরকম অহরহ প্রাণ।
মঙ্গলবার সকালে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা কাঁদিয়েছে অনেককে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায়। বিদেশ ফেরত ছেলেকে আনতে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিয়েছিলেন আব্দুর রহমান (৬৫), তার স্ত্রী কুলসুম বেগম (৫৫) ও নাতনিসহ আরও কয়েকজন। কিন্তু বিমানবন্দরে তাদের আর যাওয়া হলো না। পথিমধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল তাদের। কাভার্ড ভ্যানে আটকে গিয়ে একটি মাইক্রোবাসে আগুন ধরে গেলে তাতে জীবন্ত দগ্ধ হন হতভাগ্য বাবা-মা। তাদের সঙ্গে মারা গেছেন মাইক্রোবাসের চালক রুহুল আমিনও (৩৫)।
এর আগের দিন গোপালগঞ্জেও ঘটেছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। যেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের পাঁচজন।
নতুন গাড়ি কিনেছিলেন গোপালগঞ্জ সদর থানা যুবলীগের সহসভাপতি সাদিকুল আলম। সে গাড়ি নিজে চালিয়ে চার বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন খুলনায়। বেড়ানো শেষে গত রোববার রাতে ফেরার পথে খুলনার রূপসা ব্রিজ এলাকায় হঠাৎ গাড়ির সামনে এসে পড়েন মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তি। তাকে বাঁচাতে গিয়ে ডানে স্টিয়ারিং ঘোরাতেই বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মালবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখী সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে যায় তাদের প্রাইভেট কারটি। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সাদিকসহ পাঁচজন। অন্যরা হলেন-গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক বাবু (২৬), জেলা ছাত্রলীগের ছাত্র উপবৃত্তি-বিষয়ক সম্পাদক গাজী ওয়ালিদ মাহমুদ উৎসব (২৫), জেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সাজু আহমেদ (২৪) ও সদর উপজেলা ছাত্রলীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক অনিমুল ইসলাম (২৪)। পাঁচজনের মধ্যে সাদিকুল আলমই বয়সে সবার বড়। তার বয়স ছিল ৩২।ৎ
এভাবেই সড়কের এ মৃত্যু উপত্যকায় প্রতিদিন নাম লেখাচ্ছেন গড়ে ৬৫ জন। সড়কের এমন ভয়াবহ মহামারী থামাতে পারছে না কেউ। উপরন্তু দিনকে দিনে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে সড়ক। মৃত্যুর হার যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছে সড়কে চলাফেরা। গণমাধ্যমে এ নিয়ে লেখালেখি, প্রতিবেদন প্রকাশ, শিক্ষার্থী-পেশাজীবীদের আন্দোলন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বক্তৃতা-বিবৃতিতেও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। সরকার ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই চরম উন্নাসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। কোনোভাবেই সড়কে মৃত্যু ঠেকানোর উপায় বাতলাতে পারছে না কেউ।
সড়কে এমন বিশৃঙ্খলার পেছনে পরিবহন খাতে চরম নৈরাজ্য, ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাবে বিস্তৃত সিন্ডিকেট ব্যবসা, শ্রমিকদের অতিরিক্ত খাটুনি, বিশ্রামের অভাব, অদক্ষ চালক ও হেলপারদের দৌরাত্ম্য, মাদক সেবন, সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইত্যাদিকে দায়ী করা হলেও এ রাহুর হাত থেকে সড়ক খাতকে বাঁচাতে পারছে না সরকার। ফলে যাত্রী ও পথচারীদের জীবন আজ মহাবিপন্ন বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে সড়ক কেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হচ্ছে? এ উপত্যকা থেকে কবে রক্ষা পাবে যাত্রীদের জীবন? কোনোভাবেই কি কোনো কিছু করার নেই সরকারের? কোনোভাবেই কি ফেরানো যাবে না নিরাপদ সড়ক?
বিশ্লেষকদের গবেষণা ও বিশ্লেষণও তো কম হয়নি। কিন্তু সরকার কী ভাবছে এ নিয়ে? গতকাল সচিবালয়ের নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই বলেছেন, মহাসড়কে একের পর এক দুর্ঘটনাকেই এখন ‘সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনার বিষয়’ হিসেবে দেখছেন তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি নিজেই বলেছি সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি। অবকাঠামোগত প্রকল্পে যত অগ্রগতি, সেই তুলনায় সড়ক ও পরিবহনে শৃঙ্খলাটা অতটা হয়নি, যার জন্য অ্যাক্সিডেন্ট বা যানজট রয়েছে।’
গত ১০ বছরেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। তাহলে সরকার এবার কী করার কথা ভাবছে-এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল তার কাছে। তিনি বলেছেন, ‘শিগগিরই সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভা ডাকা হবে। কমিটি সাজানো হবে নতুন করে। নতুনভাবে প্রোগ্রাম নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি। নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় সড়ক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি করে দেব। তাদের কাছ থেকে অল্প দিনের ব্যবধানে প্রতিবেদন চাইব, পরে যদি টাস্কফোর্স করতে হয় তাও করব। সড়কে মৃত্যুর এ মহামারীর লাগাম টানতে সরকারি উদ্যোগের কথাও বলেছেন তিনি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান বলেছে, গত বছর সড়কে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ২২১ জন। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। দেশের সড়ক এমন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে যে যাত্রী, পথচারী সবাই এখন প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন।
বাসের ধাক্কায় যেভাবে প্রাণ গেল তাসিমের
রাজধানীর শেওড়া রেলগেটের সামনে সোমবার বিকালে রেল ক্রসিং পার হচ্ছিলেন সেন্ট জোসেফ কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র আদনান তাসিম। এ সময় তাকে চাপা দেয় একটি বাস। এতেই গুরুতর আহত হয় তাসিম। পরে তার মৃত্যু ঘটে।
তাসিমের সহপাঠী ও দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বায়েজিদ বলেন, কলেজ থেকে বাসে শেওড়া রেলগেটে নেমে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তখন দ্রুতগতিতে লাল রঙের একটা বাস এগিয়ে আসে। তখন তাসিম ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। বাসটাও একটু টার্ন করে। এতে চলন্ত বাসটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে যায় তাসিম। গুরুতর আহত অবস্থায় তাসিমকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলে দায়িত্বরত চিকিৎসক। কিন্তু আমরা তাসিমকে সিএমএইচে নিয়ে যাই। সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আদনান তাসিমের বাবার নাম আহসান উল্লাহ। পরিবারের সঙ্গে যমুনা ফিউচার পার্কের পাশে ওলি পাড়ায় একটি বাসায় থাকত তাসিম। তাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে।
বিদেশফেরত ছেলেকে আনতে গিয়ে প্রাণ গেল বাবা-মায়ের
বিদেশ ফেরত ছেলেকে আনতে বিমানবন্দরে আর যাওয়া হলো না বাবা-মায়ের। পথিমধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল তাদের। কাভার্ড ভ্যানে আটকে গিয়ে একটি মাইক্রোবাসে আগুন ধরে গেলে তাতে জীবন্ত দগ্ধ হন হতভাগ্য বাবা-মা। তাদের সঙ্গে মারা গেছেন মাইক্রোবাসের চালকও। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের আব্দুর রহমান (৬৫), তার স্ত্রী কুলসুম বেগম (৫৫) এবং রুহুল আমিন (৩৫)। রহুল আমিন মাইক্রোবাসের চালক। এ ঘটনায় আহত আব্দুর রহমানের দুই নাতি রনি ও রাসেলকে মাইক্রোবাস থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
মিরসরাই থানার ওসি জাহিদুল কবীর জানিয়েছেন, রহমান-কুলমুস দম্পতির এক ছেলে বিদেশ থেকে আসার কথা। ছেলেকে আনতে সকালে তারা কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমান বন্দরে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে মিরসরাই উপজেলার নিজমাপুর কলেজের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পড়েন।
মাইক্রোবাস ও কাভার্ড ভ্যান দুটোই চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। হাদি ফকির হাট এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের পেছন দিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাইক্রোবাসটি আটকে যায়। ওই অবস্থায় মাইক্রোবাসটিকে নিজামপুর বাজার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় কভার্ড ভ্যানটি। এর মধ্যে মাইক্রোবাসে আগুন ধরে যায়। এতে মাইক্রোবাস আরোহী পাঁচজনের মধ্যে তিনজন জীবন্ত দগ্ধ হয়।
সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা ওয়াসী আজাদ জানান, দুই গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের পর মাইক্রোবাসটির সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। মাইক্রোবাসের জানালা ভেঙে রনি ও রাসেলকে বের করতে পারায় তারা প্রাণে বেঁচে যায়। দুর্ঘটনার পর স্বজনরা এসে নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন