গৃহভ্যন্তরে সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে গত রোববার। ঠিক ওই দিনই রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের নিজ বাসায় খুন হন ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীন। এ ছাড়া গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকায় ভাবী হাসিনা বেগমকে ঘুমন্ত অবস্থায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করে দেবর লিমন। এ ঘটনার তিন দিনও না যেতেই রাজধানীতে সোমবার সন্ধ্যায় দেবর শফিকুল ভাবি শারমিন আক্তারকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজধানীসহ সারা দেশে এমন খুনের ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই যাচ্ছে। এতে করে উদ্বেগ বাড়ছে জনমনে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এসব খুনের আসামিদের ধরা এবং প্রকৃত কার্যকারণ উদ্ঘাটন করার বেলায় খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে করে উদ্বেগ-আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে আরও কয়েক গুণ।
২০১৫ সালের ৩০ মার্চ মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ভাড়া বাসায় হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে মারা যান আদাবরের মিশন ইন্টারন্যাশনাল কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রভাষক কৃষ্ণা কাবেরী মণ্ডল। এমন নৃসংশ খুনের শিকার হয়েছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৩ সালের ২৮ আগস্টের কথা। ওইদিন সিআইডি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম খানকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পত্রিকা পড়া অবস্থায় তিন যুবক গুলি করে হত্যা করে নিজ বাসার ভেতর। দীর্ঘ সময় পরেও পুলিশ সেই ঘটনারও কিনারা করতে পারেনি।
গত কয়েক বছরে এমন হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, দিন শেষে যে গৃহকে মানুষ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করে সেখানকার নিরাপত্তা কোথায়? আতঙ্কের বিষয় হলো, বেশির ভাগ সময় ঘটনাগুলো ঘটছে ঘরের মানুষের দ্বারাই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গৃহকর্মীদের দ্বারা। তাই বিশেষজ্ঞরা এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীনতা বা অসতর্কতাকেও দায়ী করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান খোলা কাগজকে বলেন, ‘নিরাপত্তার জন্য সরকারের উচিত তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো। একই সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবেও সবাইকে সচেতন হতে হবে, কারণ এককভাবে সরকারের পক্ষ থেকে লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব না।’
এদিকে গৃহভ্যন্তরে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীন (৬০) হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর নিউমার্কেট থানায় দুই গৃহকর্মীসহ তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন তার স্বামী ইসমত কাদির গামা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। এ ছাড়াও অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীনকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে জানান ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মাহফুজার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
পরিচয় নিশ্চিত জেনেই কাজে নিতে হবে
সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান
শিক্ষক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাবি
গৃহকর্মী বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য যারা কাজ করেন তাদের পরিচয়ের ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র এবং তাদের চেনে এমন মানুষের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের কাজের সুযোগ দিতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা অনেকটা উদাসীন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেই না। যেসব সংস্থা বেসরকারি নিরাপত্তা বা গৃহকর্মী সরবরাহ করে থাকে তাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম। সবার নিরাপত্তার জন্য সরকারের উচিত তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো। সেই সঙ্গে সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে, কারণ লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের পক্ষ থেকে এককভাবে সম্ভব না।
একক পরিবারে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে
শাহানুর হোসেন
শিক্ষক, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, ঢাবি
মানুষের এখন নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, একে অপরকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। এক সময় এ দেশের অধিকাংশ মানুষ পরিবারের সঙ্গে বসবাস করত। কিন্তু এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একা থাকতে পছন্দ করছে। এতে বৃদ্ধ বয়সে মানুষকে গৃহকর্মীর ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। আমরা একটা সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সমাজ যেভাবে মানুষকে চায় মানুষ সেভাবে পরিবর্তন হয়, আবার মানুষ যেভাবে চায় সমাজ সেভাবে পরিবর্তন হয়। একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। একক পরিবারের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কমে গেছে। ফলে অপরাধীরা সুযোগ পাচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন