ঢাকার অদূরে প্রকৃতির লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গাছগাছালি ঘাস আর লতাগুল্ম আবৃত ৭০০ একরের এক বনময় পরিবেশ। স্বাভাবিকভাবেই অধিবাসীদের সাথে মিতালি করে এখানে বসবাস করে নানা প্রজাতির পাখি, প্রাণী, সরিসৃপ আর কীটপতঙ্গ। অন্য সবার সাথে সখ্য থাকলেও এখানকার অধিবাসীদের সাথে এখনও সেভাবে মিলমিশ গড়ে ওঠেনি সাপেদের। হলগুলোতে প্রায়ই ঢুকে পড়ে বিভিন্ন সাপ। আর শিক্ষার্থীদের হাতে বেহুদা প্রাণ হারায় প্রকৃতির এই অকৃত্রিম বন্ধুটি। আর সেটা কেবলই ভুল বোঝাবুঝি আর অজ্ঞতার কারণে।
এ বিষয়টি ভীষণ পীড়া দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমানকে। তাই সাপ বাঁচাতে হয়ে উঠেছেন স্বেচ্ছাসেবী ‘সাপুড়ে’। গঠন করেছেন উদ্ধারকারী দল ‘স্ন্যাকস রেসকিউ টিম’। মাহফুজের নেতৃত্বে পরিচালিত এই দল সাপ রক্ষায় শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করে যাচ্ছেন- যেন ক্যাম্পাসের কোথাও সাপ দেখলে মেরে ফেলা না হয়। আর হলে ঢুকে পড়লে যেন তাদের খবর দেয়া হয়। যাতে করে তারা গিয়ে উদ্ধার করতে পারেন। সব শিক্ষার্থীর কাছে এখনও বার্তা না পৌঁছালেও যা সাড়া পাচ্ছেন সেটিকে ইতিবাচকই মনে করছেন মাহফুজ। ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটি সাপকে উদ্ধার করে জঙ্গলে অবমুক্ত করেছেন মাহফুজ ও তার দল। তবে এর মাঝেও যা মারা পড়ছে তার সংখ্যাও কম নয়।
মাহফুজের সহায়তাকারী হিসেবে এখন পর্যন্ত কাজ করছেন ৩-৪ জন সেচ্ছাসেবী। তবে মাহফুজ চাচ্ছেন দলটিকে আরও বড় করতে।
মাহফুজ বলেন, ‘অন্তত ১২-১৫ জন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে চাই। তবে আমাদের দলে এখন সবচে বেশি প্রয়োজন নারী সদস্যের। কারণ মেয়েদের হলে প্রায়ই সাপ মারা পড়ে। মেয়েদের হলে ছেলেরা ঢুকতে পারে না বলে সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব নয় আমাদের।’
‘কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। যেমন সাপ ধরার জন্য আমাদের কয়েকটি ক্যাচার দরকার। সংগ্রহে থাকার দরকার এন্টিভেনম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি নেই। অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে গিয়েও পাওয়া যায় না,’ যোগ করেন মাহফুজ।
মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে ২০১৫ সাল থেকেই সাপ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন মাহফুজ। সাপ সম্পর্কে জানতে নিজ এলাকা মাগুরায় অনেক দিন মিশেছেন স্থানীয় সাপুড়ে বেদেদের সাথে। দু’-একটি সাপ উদ্ধারও করেছেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেন সাপ উদ্ধারে আরও সক্রিয় কাজ করার। শুরু করেন সাপ নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা।
মাহফুজের ভাষায়- ‘সাপ নিয়ে কাজ করতে, জানতে আপনাকে প্রাণীবিদ্যায় পড়তে হবে এমন কোন কথা নেই। প্রয়োজন প্রবল আগ্রহ আর ভালোবাসা।’
এ পর্যন্ত ৪০টির মত সাপ উদ্ধার করেছেন মাহফুজ। এর মধ্যে ৩০টিই ছিলো বিষাক্ত গোখরার বাচ্চা। ছিল কেউটেও। সাপ উদ্ধার করতে গিয়ে সাপের কামড় খেয়েছেন তাও কম নয়। তবে আশার বিষয় হচ্ছে সবগুলোই ছিলো নির্বিষ সাপ।
মাহফুজ বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব সাপ আছে তার মধ্যে কোনগুলো বিষাক্ত আর কোনগুলো নির্বিষ সে সম্পর্কে আমার মোটামুটি জানাশোনা আছে। নির্বিষ সাপ কামড় দিলে সামান্য ব্যথা হয় মাত্র।’
তবে অন্তত একবার ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারত। একবার একটা ছোট কুয়ায় একটা সাপ পড়ে থাকতে দেখে সেটিকে হাত দিয়ে ধরে তুলে আনেন মাহফুজ। মাহফুজ মনে করেছিলেন সেটি ছিল নির্বিষ ঘরগিন্নি সাপ। কিন্তু তোলার পর দেখেন ওটা বিষাক্ত কমনক্রেইট (কেউটে)। তার ভাষ্যে, ‘ওটা কামড় দিলে বাঁচা সহজ ছিল না।’
মাহফুজের মতে, ‘সাপ সম্পর্কে রয়েছে মানুষের প্রচুর ভুল ধারণা আর অহেতুক ভয়। আমাদের দেশে মানুষ মনে করে কালনাগিনী সাপ অনেক বিষাক্ত সাপ। কিন্তু এটা একটা নির্বিষ সাপ। আমি নিজেই কয়েকবার কালনাগিনীর কামড় খেয়েছি।’
মাহফুজের দাবি, জাহাঙ্গীরনগরে যেসব সাপ পাওয়া যায় তার অধিকাংশই দাড়াস অথবা ঘরগিন্নি। যেগুলো নির্বিষ। খুবই অল্প পরিমাণে কিছু বিষাক্ত খইয়া গোখরা রয়েছে। কমনক্রেইট (কেউটে) রয়েছে বলেও শুনেছেন তবে নিজে দেখেননি।
এ তথ্যগুলোর সাথে একমত হয়েছেন প্রাণী গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বিষাক্ত সাপ এখানে পরিমাণে খুবই কম। গোখরা আর কেউটে রয়েছে। কেউটে আমরা দেখেছিলাম সর্বশেষ দু’বছর আগে। বাকী সবই নির্বিষ।’
তবে সাপ উদ্ধারের সময় শিক্ষার্থীদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ এ অধ্যাপকের। কারণ অনেক সময় বিষাক্ত সাপও নির্বিষ সাপের মত আচরণ করে। ফলে চেনা কঠিন হয়ে যায়।
সাপ কিভাবে মানুষ ও পরিবেশের উপকার করে তার একটা উদাহরণ দিয়ে মাহফুজ বলেন, ‘ইঁদুরের উৎপাত ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। যেখানে দাড়াস সাপ থাকে সেখানে ইঁদুরের উৎপাত থাকে না। দাড়াস সাপ না থাকলে ইঁদুর দমনে বিষ প্রয়োগ করতে হয়। এটা অন্যান্য প্রাণী ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া ইঁদুর মরার পর বিভিন্ন রোগের জীবাণু ছড়ায়। সাপে খেলে যেটার কোন সম্ভাবনা। এভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাপের অবদান অপরিসীম।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে মাহফুজের প্রত্যাশা সাপ সম্পর্কে যেন তারা জানার চেষ্টা করেন আর অহেতুক ভয় না পান। তাহলেই সচেতনতাটা ছড়িয়ে পড়বে দেশময়।
হলের রুমে মাহফুজের সাথেই বসবাস একটি নির্বিষ স্যান্ড বোয়া সাপের। এটিকে পেলেপুঁষে বড় করছেন মাহফুজ।
সাপের সাথে যেহেতু বসবাস তাহলে সাপুড়ে বললে কোন আপত্তি আছে কিনা? জানতে চাইলে হেসে বলেন, ‘কোন আপত্তি নেই।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন