বলা হয়ে থাকে, অর্থমন্ত্রীর সফলতার ওপরই সরকারের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর। এমন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় টানা ১০ বছর সামলেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়ে এসেছেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তার কাছে চাওয়া ছাড়াও অর্থনীতির নানা বাঁক নিয়ে পরিবর্তন ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফরিদ আহমেদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও দেশবরণ্যে অর্থনীতিবদ আবু আহমেদ—
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে এসেছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার অধীনে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কি কোনো পরিবর্তন আসবে?
অতীতের তুলনায় এবার ভাল অর্থমন্ত্রী দিয়েছে সরকার। আমি মনে করি, নতুন অর্থমন্ত্রী ভাল করবেন। অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আগের চাইতে ভাল হবে। কারণ, তিনি অর্থনীতি বুঝেন, অর্থনীতির মূল জায়গাগুলো সম্পর্কে তার ভাল জ্ঞান আছে। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ (রাজস্ব) সম্পর্কে উনার ভাল ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এজন্য মনে হয়, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার আর্থিক ব্যবস্থাপনা ভাল হবে। দেখুন, পুরোপুরি ভালও কিন্তু কেউ করতে পারবে না। কারণ, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা পূর্বের চাইতে ভাল হলে এটাও আমাদের জন্য বিরাট পাওয়া হবে।
নতুন অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যে, এতদিন দেশের সবচেয়ে বেশি অবহেলিত খাত অর্থনীতি। তার কাজের অগ্রাধিকার কী হবে এবং তাতে কতটুকু কতটুকু সফল হতে পারবেন বলে আপনি মনে করেন?
অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। উনি জানেন বিষযগুলো। ব্যাংকিংও জানেন। ট্যাক্স ইস্যুগুলোও জানেন। এছাড়া ক্যাপিটাল মার্কেট সম্পর্কেও উনার অনেক ভাল ধারণা রয়েছে। আমার মনে হয়, বহুদিন পরে হলেও একটা ভাল হাত অর্থ মন্ত্রণালয়ে এসেছে। দেখেন এটার প্রতিফলন শেয়ার মাকের্টে কিন্তু ইতোমধ্যে পড়েছে। শেয়ার মার্কেট এই কারণেই বৃদ্ধির দিকে।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর পেছনে কারণ কি?
পুঁজিবাজারের মানুষজন মনে করছে, অর্থমন্ত্রী যেহেতু কোথায় কোথায় সমস্যা, তা জানেন। সুতরাং যা যা করার দরকার, তিনি তা করবেন। এই আশা থেকে পুঁজিবাজারে একটা আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। দেখুন, এক্সপেকটেশান হলে তখন সবকিছু বাড়তেই থাকে। এছাড়া বিনিযোগকারীরা কিছুটা আস্থা পাচ্ছেন, এই ভেবে একজন দক্ষ অর্থমন্ত্রী দায়িত্বে এসেছেন।
আমাদের পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা কি বলে আপনি মনে করেন? এখানে অর্থমন্ত্রী কি ভূমিকা রাখতে পারবেন?
পুঁজিবারের মূল সমস্যা ভাল শেয়ারের অভাব। পুঁজিবাজারের গভীরতার অভাব। অর্থমন্ত্রী যদি ভাল কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভূক্তির জন্য উদ্যোগ নেন, তাহলে এটা হবে সবচেয়ে কার্যকরি সিদ্ধান্ত। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, দেশীয় ভাল কোম্পানি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভূক্ত করতে পারেন অর্থমন্ত্রী। অন্ততঃপক্ষে বছরে যদি একটা ভাল কোম্পানিও পুঁজিবাজারে আনতে পারেন, সেটাও অনেক বড় অর্জন হবে তার জন্য। এতে পুঁজিবাজারের গভীরতাও বাড়বে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। এটা কী আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?
খেলাপি ঋণতো গত কয়েক বছরে শুধু বেড়েছেই। আগের অর্থমন্ত্রী এটা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে নতুন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, খেলাপি ঋণ আর বাড়তে দিবেন না। আসলে আমাদের দেশের যে অবস্থা, তাতে খেলাপি ঋণ যদি এখন যেখানে আছে, সেখানেও রাখা সম্ভব হয়, তবে অনেক বড় অর্জন হবে। আমি আশা করি, তিনি (অর্থমন্ত্রী) চাইলে খেলাপি ঋণের হার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। এমনকি অর্থমন্ত্রী চাইলে খেলাপি ঋণের হার কমাতেও পারবেন।
খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনের পরিবর্তনের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক-কোম্পানি আইন পরিবর্তনে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে নাতো?
অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। আইনের ফাঁক-ফোকরের কারণেও কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া যায় না। এজন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনের পরিবর্তন করা দরকার। কারণ, ব্যাংক-কোম্পানি আইনের বিভিন্ন ধারায় কিছু সাংঘর্ষিক বিষয় আছে। অর্থমন্ত্রী চাইলে মন্ত্রিসভায় তুলে আইন পরিবর্তন করতে পারবেন। অনেক আইনইতো দেশে পরিবর্তন হচ্ছে। এটাও হবে। ব্যাংক-কোম্পানি আইন পরিবর্তন করে খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব।
ঋণ খেলাপিরা প্রভাবশালী। এক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা আসবে কি না?
ঋণ খেলাপিরা যত প্রভাবশালীই হোক, তারা কিন্তু সরকারের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী নন। অতীতে কাউকে শক্ত করে ধরে নাই বলে তারা প্রভাবশালী হয়ে গেছেন। কাগুজে বাঁশ হয়ে গেছেন অনেক ঋণ খেলাপি। সুতরাং শক্ত করে ধরে একটা ম্যাসেজ দিতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় আর বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে এই ম্যাসেজ দিবে যে, এই ধরনের অরাজকতা আর চলতে দেব না। দেখবেন দু’একজনকে ধরলে অন্যরা এসে টাকা দিয়ে যাবে।
পাহাড়সম খেলাপি ঋণের পেছনে কী বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দায় নেই?
খেলাপি ঋণ না আদায় হওয়ার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় এবং দোষ— দুটিই রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে চলে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। এজন্য খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা আরও শক্ত হবে এই আশা করেছিলাম আমরা। কিন্তু, সেটা হয়নি। এর থেকে বের হতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিও কড়া বার্তা দিতে হবে নতুন অর্থমন্ত্রীকে।
রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক সংস্কারের কথা বলেছেন নতুন অর্থমন্ত্রী। এই সংস্কার হলে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব আসবে কি না?
দেখুন, আমাদের দেশে কখনোই রাজস্ব সঠিক হারে আদায় হয়নি বা রাজস্ব কর্মকর্তারা সঠিক হারে আদায় করেন না। বিশেষ করে ভ্যাট এখন সবাই দিচ্ছেন না। কারণ, ভ্যাটের অতিরিক্ত হার। এটা নুতন অর্থমন্ত্রী ভাল করে জানেন। ভ্যাট সঠিক হারে আদায় করার ব্যবস্থা সবার আগে করা উচিত। এখানে আরেক অরাজকতা আছে। সেটা হলো ভ্যাট কেউ এখন আদায় করে কিন্তু সরকারি কোষাগারে জমা দেন না। আবার কেউ আদায়ই করেন না। ঘুষ নিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিতে সহযোগিতা করেন। সুতরাং সঠিক ও স্বচ্ছতার সঙ্গে রাজস্ব আদায় করতে অর্থমন্ত্রী প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারেন। এ ছাড়া বর্তমানে কর হার ও ভ্যাট হার অনেক বেশি। অর্থমন্ত্রীর কথাই ঠিক। কর হার ও ভ্যাট হার কমালে রাজস্ব আদায় কমবে না বরং বাড়বে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন