আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে চলতি মাসের ৪ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯ দিনে ৯ জন নিহত হয়েছে। এরমধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ২জন, র্যা বের সঙ্গে ২জন, বিজিবির গুলিতে ২ জন ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৩ জনের মৃতদেহ। পুলিশ বলছে, নিহতরা সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ইয়াবা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলা রয়েছে।
কক্সবাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রমতে, গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দ্বিতীয় দফায় মাদক বিরোধী অভিযানে নামেন কক্সবাজার জেলা পুলিশ। এতে গত ৪ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৯ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও অস্ত্র। নিহতদের মধ্যে কক্সবাজার শহরের একজন ছাড়া বাকি সব টেকনাফে নিহত হয়েছে। এর আগে গত তিন মাসে শুধুমাত্র টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ২৭ মাদক ব্যবসায়ী। এদের দুয়েক জনের গুলিবিদ্ধ ছাড়া অধিকাংশ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।
পুলিশের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত ৪ জানুয়ারি সকাল ৭টার দিকে টেকনাফ-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়ক সংলগ্ন বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালীপাড়া সৈকত এলাকা থেকে সাজ্জাদ হোসেন ইমরান (২৪) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত যুবক চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া পশ্চিম আমিরাবাদের মাস্টারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ কালামের ছেলে। পুলিশের ধারণা, ইয়াবার চালান পাচারের সময় দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের গুলিতে ওই ব্যক্তি নিহত হয়ে থাকতে পারেন।
একইভাবে গত ৫ জানুয়ারি সকালে ৯টার দিকে টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের মেরিন ড্রাইভের নিকটবর্তী রাজারছড়া এলাকা থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতরা হলেন, টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকের মৃত কাশিমের ছেলে খাইরুল আমিন (৩৫) ও একই ব্লকের হাজী মুহাম্মদের ছেলে আব্দুল্লাহ (৪৭)।
৮ জানুয়ারি ভোরে টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া এলাকায় র্যা বের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি ওয়ান শুটারগান ও একটি কভার্ড ভ্যান জব্দ করেছে র্যতবা-৭। নিহতরা হলেন, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার নগরকুন্ড এলাকার আবদুল মতিনের ছেলে হাফিজুর রহমান (৩৫) ও বাগেরহাট জেলার চিতলমারি উপজেলার বর বাড়িয়া এলাকার মো. ইব্রাহিমের ছেলে সাব্বির হোসেন (২৫)।
৯ জানুয়ারি সকাল ৬টার দিকে কক্সবাজার শহরের কলাতলী কাটাপাহাড় এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জাহাঙ্গীর আলম কক্সবাজার শহরের রুমালিয়ারছড়া এলাকার ফরিদ আলম ওরফে দারোয়ান ফরিদের ছেলে। এসময় ২শ’ পিস ইয়াবা ও একটি দেশীয় তৈরি এলজি উদ্ধার করা হয়।
গত ১০ জানুয়ারি রাত দুইটার দিকে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের নাফনদীর খুরেরমুখ এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের আব্দুর রশিদ (৪৭) ও আবুল কালাম (৩৫) নামের দুইজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ৫টি দেশীয় এলজি এবং ২২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে তিন পুলিশ সদস্য। এরা দুইজনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি পুলিশের।
সর্বশেষ, ১২ জানুয়ারি (শনিবার) রাতে টেকনাফে সাতরিয়ে নাফ নদী পার হওয়ার সময় বিজিবির গুলিতে ২জন ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এসময় বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি করছে বিজিবি। তবে পুলিশ বলছে, অজ্ঞাতনামা দুইজনের মৃতদেহসহ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়দের দাবি নিহতরা মিয়ানমারের নাগরিক।
এ ব্যাপার টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, ‘রাতে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আনোয়ার প্রজেক্ট নামক পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদী সাতরিয়ে মিয়ানমার থেকে দুই ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এসময় সীমান্তে কর্তব্যরত বিজিবির সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চাল্য। পরে ঘটনাস্থল তল্লাশি করে দুইজনের মৃতদেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে টেকনাফ থানা পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করেছে এবং ইয়াবাগুলো জব্দ করেছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ জানান, ‘টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে যে সব ব্যক্তি নিহত হয়েছেন তারা সবাই ইয়াবা ব্যবসায়ী। এদের অধিকাংশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। এছাড়াও যাদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, এরা সবাই চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে তারা মারা গেছে। ’
র্যা ব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ী দেশের এবং সমাজের শক্রু। তাই তাদের প্রতিহত করতে হবে। গত ৮ জানুয়ারি ভোরে টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া এলাকায় র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি ওয়ান শুটারগান ও একটি কভার্ড ভ্যান জব্দ করা হয়। এছাড়াও র্যা ব পুরো জেলায় স্থল ও জলপথে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে। এসব এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।’
এদিকে, টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুয়েকজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।
উল্লেখ্য, গত এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় কক্সবাজারে ১১৫২ জনকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র টেকনাফে রয়েছে ৯১২ জনের নাম। মাদক নির্মূলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসাবে কক্সবাজার জেলার আইনশৃংখলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ীদের ধরপাকড়। এতে টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা কারাবারিরা গা ঢাকা দিলেও এখনও বন্ধ হয়নি সীমান্তের ইয়াবা পাচার। সীমান্তের ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ ও পাচারকারিদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে মাদক থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার দাবি স্থানীয় সচেতন মহলের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন