ভুল ধারণা থেকে আদরের সন্তানের লেখাপড়ার জন্য কিন্ডারগার্টেনের পেছনে ছোটেন অনেক অভিভাবক। তাদের ধারণা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মানসম্মত নয়। সেখানে অল্প বই, লেখাপড়াও কম। বিপরীতে কিন্ডারগার্টেনে অনেক বই, শিশুদের অনেক বেশি বিষয়ে পড়ানো হয়। ফলে সেখানে সন্তান সুশিক্ষা পাবে বলে মনে করেন অনেকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স-মেধা হিসাব করেই সরকার শিশুদের উপযোগী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করে।
কিন্ডারগার্টেনে প্রয়োজন ও ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি পড়ানো হয়, যা কোমলমতি শিশুর মন ও মস্তিষ্কের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের লেখাপড়া মানসম্পন্ন নয়। বিজ্ঞাপনী চাকচিক্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক অভিভাবকই সন্তানকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করান।
বিশেষ করে শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ প্রবণতা খুবই বেশি। শহরের অলিগলিতে রয়েছে সুসজ্জিত কিন্ডারগার্টেন। মোড়ে মোড়ে তাদের চকচকে বিজ্ঞাপন। বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী সন্তানদের অভিভাবকরা সহজেই তাতে প্রলুব্ধ হন। অন্যদিকে প্রতি এলাকায় সরকারি স্কুল থাকলেও তা নজরে পড়ে কম। শিক্ষার্থী টানার কোনো চেষ্টাও এগুলোর নেই; বরং প্রচলিত রয়েছে নানা নেতিবাচক কথা। এসব অপপ্রচারের জবাব দেওয়ারও কোনো তৎপরতা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে দেখা যায় না।
রাজধানীর ফরাসগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো. শামছুল হক আমাদের সময়কে বলেন, আমরা কম আয়ের মানুষ। সরকারি স্কুলে বেতন নেই, বই ফ্রি দেয়, তাই মেয়েকে ভর্তি করিয়েছি। একই এলাকার রিভারসাইড কিন্ডারগার্টেন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কামাল আহমদের মতে, সরকারি স্কুলে সব ফ্রি। আর ফ্রিতে লেখাপড়া হয় না। সরকারি কয়েকটি বই পড়ানো হয়। এখানে (কিন্ডারগার্টেন) তো আমার মেয়ে ওসব বইয়ের বাইরেও গল্প, কবিতা, শব্দার্থ শেখে। ম্যাডামরা এখানে ভালো করে পড়ান, যেটা সরকারি স্কুলে গুরুত্ব পায় না। তবে তার অভিযোগ, বাড়তি বইগুলোর দাম এবং বেতন বেশি নেওয়া হচ্ছে।
সূত্রাপুর ডালপট্টি মোড়ের কাছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জানান, এই এলাকার কম আয়ের মানুষরা তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পাঠান। কিন্তু মধ্য ও উচ্চবিত্তরা সরকারি স্কুলবিমুখ। অনেকে অভিজাত কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সন্তানদের পড়ালে গর্বিত বোধ করেন। এই শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, আমরা মাস্টার্স পাস করে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করি। বাচ্চাদের পড়াই। আর কিন্ডারগার্টেনে এসএসসি, এইচএসসি পাস হলেই চাকরি হয়ে যায়। এগুলোয় শিক্ষকদের বেতনও কম। কর্তৃপক্ষ নিয়োগের সময় বলেই নেয়, টিউশনি-কোচিং করিয়ে পুষিয়ে নিতে পারবেন।
পুরান ঢাকার কোতোয়ালি ইসলামপুরে বেস্ট এডুকেশন সেন্টার নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির আগেও শিশুদের এক বছর লেখাপড়া করানো হয়। এই স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সরকারি পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অতিরিক্ত পাঠ্যবই হিসেবে শব্দার্থ, কবিতা, গল্প, পরিবেশবিজ্ঞান, ভূগোল বই পড়ানো হয়। ইংরেজি ভার্সনে শব্দার্থ, কবিতা এবং গল্পের বই রয়েছে।
কিন্ডারগার্টেন ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাদের সময়কে বলেন, পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় একটি শিক্ষার্থীও পাস করেনিÑ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে কিন্ডারগার্টেনেরই বেশি। এর কারণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তাদের বেতন-ভাতাও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
কিন্তু কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত স্কুলের অবকাঠামো ও পরিবেশ এখনকার অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় নিম্নমানের। আগামীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হবে অভিভাবকদের মূল আকর্ষণ। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। তখন প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না বেসরকারি এ ধরনের প্রতিষ্ঠান।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় একটি শিক্ষার্থীও পাস করেনিÑ এ ধরনের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ৩৯ এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০টি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন